জেএনইউ কাণ্ডের সমর্থনে মিছিল। বুধবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
জেএনইউ-কাণ্ডের উত্তাপ ছড়াল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও। একদল পোস্টার লাগাল। ছিঁড়ল অন্যদল। জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করলেন কয়েক জন যুবক। বাদানুবাদে জড়ালেন জেএনইউ-কাণ্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী প়ডুয়াদের সঙ্গে।
তবে যাদবপুরের পরিস্থিতি তপ্ত হলেও উপাচার্য সুরঞ্জন দাস জানান, তিনি এর মোকাবিলায় প্রশাসনের সাহায্য চাইবেন না। বরং আলোচনার মাধ্যমেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী গোটা বিষয়টি নিয়ে উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন। রাজ্যপাল মুখ্যসচিবকে অন্য একটি চিঠি পাঠিয়ে ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে জানতে চেয়েছেন। রাজ্য এ নিয়ে কী পদক্ষেপ করেছে তা-ও মুখ্যসচিবকে জানাতে বলেছেন রাজ্যপাল। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, যাদবপুরে গুরুতর কিছু ঘটে থাকলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ করা হবে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উত্তেজনার শুরু মঙ্গলবার বিকেলের একটি মিছিলকে ঘিরে। জেএনইউ-এর আন্দোলনের সমর্থনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন পড়ুয়া। কিন্তু সেই মিছিলে আফজল গুরু এবং এস এ আর গিলানির সমর্থনে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান শোনা গিয়েছিল। বুধবার সকালে আফজল গুরুকে শহিদ ঘোষণা করে পোস্টারও পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। মঙ্গলবারের মিছিলের উদ্যোক্তাদের পক্ষে শৌনক মুখোপাধ্যায় বলেন, মিছিলটি ডাকা হয়েছিল জেএনইউ এবং দেশজুড়ে চলতে থাকা আরএসএস, বিজেপি ও অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ‘ফ্যাসিজমের’ বিরুদ্ধে। তবে মিছিলের একটি অংশ থেকে আফজল গুরু এবং গিলানির সমর্থনে যে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, আমরা তাকে সমর্থন করছি না। মিছিলে সে সব শুনতে পেলে তাদের সেই মুহূর্তে থামিয়ে দিতাম।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এ দিন বলেন, ‘‘মঙ্গলবার মিছিলের সময়ে ক্যাম্পাসে ছিলাম না। সংবাদমাধ্যম থেকে জানার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র সংসদের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলেছি।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘মিছিলটি কোনও ইউনিয়ন ডাকেনি। তিন জন পড়ুয়া ডেকেছিল। মনে করি, ছাত্রছাত্রীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু কেউ দেশবিরোধী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী মন্তব্য করলে তা সমর্থন করি না।’’
পুলিশকে দিয়ে ওই ঘটনার তদন্ত করানোর দাবি তুলেছে বিজেপি। তবে উপাচার্য এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘তদন্তের প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ নিজেই তা করাবেন। বাইরের কাউকে ডাকা হবে না।’’ কিন্তু যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ ওই স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় যুক্ত থাকে? সুরঞ্জনবাবুর মন্তব্য, ‘‘ওই দিন মিছিলে এ রকম কিছু ঘটে থাকলে তা কোনও ছোট গোষ্ঠী করে থাকবে। কিন্তু এ জন্য গোটা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কালিমালিপ্ত করা উচিত নয়। এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পড়ুয়া বা ইউনিয়নের কাউকে এই ধরনের স্লোগান দেওয়ার ঘটনায় চিহ্নিত করা গেলে উপাচার্য আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে চান। সুরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘পুলিশ দিয়ে কখনও বিশ্ববিদ্যালয় চালাইনি। চালাবও না।’’
মঙ্গলবারের মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পড়ুয়া ছিেলন না বলে বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়ন ও উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন। তবে ‘র্যাডিক্যাল’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যেরা এ দিন আফজল গুরু এবং গিলানির সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পোস্টার লাগায়। ওই সংগঠনের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী জুবি সাহার মন্তব্য, ‘‘আমরা মনে করি কাশ্মীরের মানুষদের অবস্থা ভাল নয়। সেই কাশ্মীরিদের জন্য আফজল গুরু লড়াই করেছিলেন বলে আমরা মনে করি। আফজল গুরু শহিদ হয়েছেন। তাই তার ফাঁসির বিরুদ্ধে আমরা প্রকাশ্যে পোস্টার লাগিয়েছি।’’ মঙ্গলবারের মিছিলে যে তাদের সমথর্কেরাই স্লোগান দিয়েছে তা জানিয়ে জুবির ব্যাখ্যা, ‘‘ওই মিছিল কোনও রাজনৈতিক ব্যানারে ছিল না। ওই মিছিলে আফজল গুরুর প্রসঙ্গ খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। মিছিলে ওই স্লোগান দিয়ে আমরা নিজেদের মত প্রকাশ করেছি।’’
জেএনইউ কাণ্ডের বিরোধিতায় পাল্টা মিছিল। বুধবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
এরই মধ্যে বুধবার পর পর দু’বার এক দল ছেলে আচমকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়ে। জাতীয় পতাকা নিয়ে ‘ভারত মাতার জয়’ স্লোগান দিতে দিতে তারা ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সায়েন্সের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সভায় গিয়ে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। দু’টি দলের মধ্যে বচসা শুরু হয়। বাইরে থেকে আসা ওই দলটি নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ পড়ুয়া বলে দাবি করে জানায়, দেশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিবাদ জানাতেই তারা মিছিল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ জানাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান শাখার কিছু আরএসএস ও এবিভিপি সমর্থক মিছিল করেছে। এবিভিপি-র রাজ্য সম্পাদক সুবীর হালদার বলেন, বৃহস্পতিবারও যাদবপুরে মিছিল বের করা হবে।
জেএনইউ-এর পথে যাদবপুরের যে পড়ুয়ারা হাঁটছে তাদের পরিণতিও একই হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ। তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেশদ্রোহীদের সবক শেখাতে ধোলাই দেওয়াই সঠিক রাস্তা।’’ বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব ক’টি ব্লকে বিজেপি আন্দোলন
শুরু করছে। যে পড়ুয়ারা দেশ-বিরোধী স্লোগান দিয়েছেন তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি করেছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে রাহুলবাবুর প্রশ্ন, ‘‘কার ভয়ে আপনি দেশদ্রোহী পড়ুয়াদের গ্রেফতার করছেন না— সিমি, জামাত না আইএস-এর ভয়ে?’’ জেএনইউ-কাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার বামপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন বিক্ষোভ দেখায় কলকাতা হাইকোর্টের সামনে।