পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী, খেটে খাওয়া মানুষ দিনের শেষে মজুরি পাবেন অন্তত দু’শো থেকে আড়াইশো টাকা। অথচ রাজ্যেরই সংশোধনাগারে তার বালাই নেই! সরকারি তথ্য বলছে, এখানকার বন্দিরা দিনভর খাটুনি শেষে পান সাকুল্যে ২৬ থেকে ৩৫ টাকা!
নিজের নিয়মকে এ ভাবে বুড়ো আঙুল দেখানোটাই এ রাজ্যে দীর্ঘলালিত রেওয়াজ। বর্তমান সরকার মেলা-খেলা-উৎসবে উপুড়হস্ত। খয়রাতির ফর্দও আড়ে-বহরে দিন দিন বাড়ছে। অন্য দিকে বছরখানেক যাবৎ বারবার দরবার করেও বন্দি-মজুরি বৃদ্ধির আবেদনে কারা দফতর সায় পায়নি। বেশ কিছু রাজ্য এই পথে অনেকটা এগিয়ে গেলেও নবান্নের হেলদোল নেই। যে মনোভাবের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ছায়াও দেখছেন অনেকে।
সাজার অঙ্গ হিসেবে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের জেলের ভিতরে কাজ করতে হয়। বিনিময়ে মজুরির ব্যবস্থা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতার ভিত্তিতে মজুরি-হারের শ্রেণিবিন্যাসও মজুত। কারা দফতরের খবর: দক্ষ (স্কিলড), অর্ধদক্ষ (সেমি-স্কিলড) ও অদক্ষ (আনস্কিলড) বন্দিদের দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ৩৫, ৩০ ও ২৬ টাকা। গত বছর তদানীন্তন এডিজি (কারা) অধীর শর্মা এই হার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কারা দফতর থেকে সেটি যায় রাজ্যের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র-সচিব (অধুনা মুখ্যসচিব) বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এখনও সাড়া মেলেনি।
কী আছে সে প্রস্তাবে?
কারা-সূত্রের খবর: তাতে বলা হয়েছে, রাজ্য নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বন্দি-মজুরিও দু’শো টাকার মতো করা হোক। প্রাপ্ত মজুরির বড় অংশ দিয়ে বন্দি ও তাদের পরিবারের স্বার্থে তহবিল গড়া হোক। এ-ও বলা হয়েছে, খাওয়া বাবদ বন্দিপিছু সরকারের খরচ হয় দৈনিক প্রায় ৫৪ টাকা। সেটাও কয়েদির রোজগার থেকে কেটে নেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ, সে ক্ষেত্রে নিজের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া পারিশ্রমিক থেকে নিজের খাওয়ার খরচ জোগাবেন বন্দিরাই। এতে ওঁদের মধ্যে ‘আত্মমর্যাদার মনোভাব’ গড়ে উঠবে বলে দফতর আশাবাদী। পাশাপাশি অন্য উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা। ‘‘কেউ হয়তো কোনও পরিবারের একমাত্র রোজগেরেকে খুন করেছেন। তাঁর মজুরির টাকায় দুর্গত পরিবারটিকে সাহায্য করা যায়।’’— পর্যবেক্ষণ এক কারা-কর্তার।
বস্তুত কেন্দ্রের তরফে এমন প্রস্তাব ইতিমধ্যে এসেছে। একই ভাবে মুক্তিপ্রাপ্তদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় টাকার খানিকটার সংস্থানও বন্দিদের মজুরির একাংশের মাধ্যমে করার কথা ভাবা হয়েছে। দফতরের প্রস্তাব— মজুরি বাড়িয়ে প্রতি বন্দির নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হোক। ওঁদের প্রাপ্তির কিছু অংশ সেখানে নিয়মিত জমা পড়ুক। আর তা দিয়ে তহবিল গড়ে এমন বিবিধ কাজে লাগানো হোক। তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, বিহারের মতো কিছু রাজ্য এই ব্যবস্থা চালু করেছে বলে জানাচ্ছেন আধিকারিকেরা।
কিন্তু বাংলা এখনও সে পথে হাঁটতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় বন্দিদের নামমাত্র টাকায় খাটানোর প্রবণতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল হিসেবে অভিহিত করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নাগরিক মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সরকার নিজের ঠিক করা ন্যূনতম মজুরি বন্দিদের দিচ্ছে না! এটা আইনসম্মত নয়।’’
বন্দি-মজুরি বাড়ছে না কেন?
প্রশাসনের শীর্ষ মহলের একাংশের যুক্তি— সরকারি কোষাগারে হাঁড়ির হাল। অতএব, কারার সুপারিশ মানা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও উৎসব-খয়রাতি কী ভাবে চলছে, সে প্রশ্নের জবাবে অবশ্য ওঁরা নীরব।