Jammu And Kashmir

কাশ্মীর ছেড়ে আজই ওঁদের রওনা দেওয়ার কথা ছিল, সাগরদিঘির গ্রামে হাহাকারে মিশে আক্ষেপ

বুধবার সকালে গ্রামের রাস্তায় ছোট ছোট জটলা। পুলিশ, জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের আনাগোনা।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

বাহালনগর (সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ) শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:২২
Share:

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কামরুদ্দিনের পিসি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বুধবারই রওনা দেওয়ার কথা ছিল ওঁদের। রওনা হয়েওছেন। কিন্তু জীবিত নইমুদ্দিন, রাফিকুল, কামরুদ্দিনরা নন। কাশ্মীর উপত্যকা থেকে রওনা দিল তাঁদের কফিন বন্দি দেহ। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পেরিয়ে, যে গ্রামে ওঁদের দেহ এসে পৌঁছচ্ছে, মুর্শিদাবাদের সেই বাহালনগরে এখন শোক-হাহাকারের মধ্যেই মিশে তীব্র আক্ষেপ, হায় রে... আর কয়েকটা ঘণ্টা পেলেই বেঁচে যেত ওরা!

Advertisement

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মোরগ্রামের মোড়টা পেরোলেই, রাস্তার পাশে বাহালনগর গ্রাম। মঙ্গলবার এই গ্রাম থেকে কাজ করত যাওয়া পাঁচ শ্রমিককে কাশ্মীরের কুলগামে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। বুধবার সকালে গ্রামের রাস্তায় ছোট ছোট জটলা। পুলিশ, জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের আনাগোনা। কেউ মোবাইলে, আবার কেউ টিভির পর্দায় বার বার চোখ রাখছেন। সবাই জানেন। তার পরও যেন ঘোরটা কাটেনি, কাটছে না কিছুতেই।

যেমন ঘোর কাটেনি বছর কুড়ির মাবিয়া বিবির। মাটির দাওয়ায় শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা মাবিয়া মাঝে মাঝেই অস্ফুটে বলে উঠছেন— “...আজই তো ট্রেনে চাপার কথা ছিল।” পাশেই বসেছিলেন মাবিয়ার জা রেশমা বিবি। তিনি বলেন, ‘‘সোমবারই মাবিয়াকে ফোন করেছিল আমার দেওর রাফিকুল। বলেছিল, মঙ্গলবার রওনা দেবে, তা না হলে বুধবার ভোরবেলা...।”

Advertisement

আরও পড়ুন: হত্যালীলা: কাশ্মীরে জঙ্গি গুলিতে হত ৫ বাঙালি শ্রমিক​

একই কথা জানতেন বছর ৫৬-র রফিক শেখের স্ত্রী-ও। তাঁদের ছোট মেয়ে পরভীন জানালেন, ‘‘আব্বুরা তো গতকাল রাতেই মালপত্র, ব্যাগ বেঁধে রেডি করে রেখেছিল। আজ ভোরবেলা রওনা দেবে বলে গাড়িও বুক করে রেখেছিল।” পরভীনের কথাতেই জানা গেল, গত দশ বছর ধরে কাশ্মীরে যাচ্ছেন রফিক শেখ, দুটো পয়সা বাড়তি আয়ের জন্য।

শুধু রফিকই নন। বাহালনগরের কয়েকশো মানুষ ফি বছর পাড়ি দেন ভূস্বর্গে, পেটের টানে। যেমন নিহত কামরুদ্দিনের দাদা বাকের আলি। এ দিন তাঁকে গ্রামেই পাওয়া গেল। বললেন, ‘‘অন্য বছর তো জুলাই মাস শেষ হলেই সবাই চলে যায়। এ বার ওই ৩৭০ ধারা তোলা নিয়ে গণ্ডগোলের জন্য প্রথমে কেউ যায়নি। ভাই গিয়েছে মাত্র ২৬ দিন আগে।” বাকের আলি নিজেও বেশ কয়েক বছর কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করতে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা গ্রামে যে কোনও বাড়ি যান... কেউ না কেউ কোনও না কোনও বছর ওখানে গিয়েছে কাজ করতে।” গ্রামের বাসিন্দাদের কথায়, কাজ মানে দিন মজুরি। আপেল বাগিচায় আপেল পাড়া থেকে শুরু করে ধান কাটার মতো কাজ। তবে মজুরিটা এ রাজ্যের তুলনায় অনেকটা বেশি।

আর এই একটু বেশি রোজগারের টানেই কাশ্মীর পাড়ি দেন এখানকার মানুষ। বাকের আলির আক্ষেপ, ‘‘ভাইটাকে এ বার না করেছিলাম যেতে। এখানে কখনও জমিতে কাজ করত, নয়তো মোটর ভ্যান চালাত। রোজগার ভাল হচ্ছিল না গত কয়েক মাস ধরেই। এর মধ্যে ভাইয়ের বড় মেয়ে রহিমার কিডনির অসুখ ধরা পড়ল। মেয়েটার চিকিৎসা করানোর জন্যই সবাই বারণ করার পরও জোর করে গেল কামরুদ্দিন।” উঠোনের এক পাশে তখন রহিমাকে আঁকড়ে, পরনের শাড়ির খুটটা দাঁতে চেপে কান্না চাপার চেষ্টা করছে কামরুদ্দিনের স্ত্রী রওশনারা। রহিমা ছাড়াও রয়েছে তাঁর আরও দু’টি মেয়ে, এক ছেলে।

শোকার্ত রফিকুল শেখের পরিবার। —নিজস্ব চিত্র।

স্বামীর দিন মজুরির টাকা ছাড়া আর কোনও সম্বল নেই। ভিটে ছাড়া নেই এক ছটাক জমিও। কান্না চেপে রওশনারা এগিয়ে গেলেন বিডিও অফিস থেকে আসা আধিকারিকদের ভোটার কার্ড আর আধার কার্ড দেখাতে।

বাহালনগরের পঞ্চায়েত সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান পেশায় শিক্ষক। বাড়িতে ঢুকলেই বোঝা যায় বেশ অবস্থাপন্ন। পাঁচিল ঘেরা পাকা বাড়ি। তাঁর কথায়, ‘‘এ গ্রামের একটা শ্রেণি বেশ অবস্থাপন্ন। আশেপাশের অন্য অনেক গ্রামের তুলনায় এখানে শিক্ষার হারও ভাল। তবে গ্রামের ৬০ শতাংশ মানুষেরই পেশা দিনমজুরি। প্রত্যেকেই ভূমিহীন। এখানে তেমন কোনও কাজও এঁরা পান না সারা বছর, যাতে ওঁদের বলতে পারি কাশ্মীর না যেতে।”

কামরুদ্দিনের স্ত্রী রওশনারা।—নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: পাশে থাকার বার্তা মমতার, কাশ্মীরে নিহত শ্রমিকদের বাড়িতে অধীর, চিঠি মোদী-অমিতকে​

সকাল গড়িয়ে দুপুর। একের পর এক সরকারি আধিকারিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা চলছে গ্রামে। সকালে গ্রামে গিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। যাবেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। গ্রামের মানুষরা খোঁজ নিচ্ছেন কখন মৃতদেহ এসে পৌঁছবে। তার মধ্যেই গ্রামের মানুষদের কাছে খবর এসেছে, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন— মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে এককালীন সাহায্য করবে রাজ্য সরকার।

রফিক শেখের বাড়ি থেকে কয়েকশো গজ দূরে মিরাজ শেখের বাড়ি। মঙ্গলবার কুলগামের কাতরাসু গ্রামে যখন হত্যালীলা চলছে, ঠিক তখনই গ্রামে পৌঁছেছেন মিরাজ। তিনিও একই কাজ করতে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। গিয়েছিলেন কাতরাসু থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চিত্রা গ্রামে। রফিক শেখের মতো তিনিও গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বছরের তিনটে মাস কাটান ভূস্বর্গে। গভীর রাতে তিনি জানতে পারেন কাতরাসুর ঘটনা। ভাত খেয়ে হাত ধুচ্ছিলেন। সাংবাদিক শুনেই জিজ্ঞাসা করলেন, মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান দেওয়ার খবরটা ঠিক কি না? ঠিক খবর শুনে বললেন, ‘‘তাও ভাল। পরিবারগুলো বেঁচে যাবে। আমাকে তো আবার যেতে হবে।” তাঁর কথা শুনে পিছন থেকে স্ত্রী প্রতিবাদ করে ওঠেন। উঠোনে থাকা বাকিরাও বলে ওঠেন, ‘‘আর কেউ কাশ্মীর যাবে না এই গ্রাম থেকে।” প্রৌঢ় মিরাজ শুধু বলেন, ‘‘না গেলে গোটা বছর খাব কী?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন