নারী বাহিনীর ফুটবল বিপ্লবে তপ্ত জঙ্গলমহল

সবুজ মাঠের বুক চিরে কখনও ছোট ছোট পাস, কখনও লম্বা শট। ছুটছে এক দঙ্গল দামাল মেয়ে। পেটানো, ছিপছিপে চেহারা সব। ভেজা মাটি, বর্ষায় ভিজে শাল-মহুয়ার সবুজ পাতাগুলো যেন আরও সবুজ। ফুটবলে পড়ছে শট, যেন মাদলে পড়ছে ঘা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৭
Share:

সম্প্রতি মেদিনীপুরে একটি টুর্নামেন্টে মেয়েরা।— ফাইল চিত্র।

সবুজ মাঠের বুক চিরে কখনও ছোট ছোট পাস, কখনও লম্বা শট। ছুটছে এক দঙ্গল দামাল মেয়ে। পেটানো, ছিপছিপে চেহারা সব। ভেজা মাটি, বর্ষায় ভিজে শাল-মহুয়ার সবুজ পাতাগুলো যেন আরও সবুজ। ফুটবলে পড়ছে শট, যেন মাদলে পড়ছে ঘা।

Advertisement

পথ দেখিয়েছিল পুরুলিয়া। সেই পথে এ বার হাঁটছে জঙ্গলমহলের আর এক জেলাও— পশ্চিম মেদিনীপুর। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে আগামিকাল, ৪ জুলাই থেকে মেদিনীপুর সদর মহকুমায় শুরু হতে চলেছে মহিলা ফুটবল লিগ। যোগ দেবে মোট ১২টি দল।

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর— মূলত পুলিশের উদ্যোগে চালু হওয়া ‘জঙ্গলমহল কাপ’-এর দৌলতেই এই তিন জেলায় আজ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের ফুটবল। মাওবাদী সন্ত্রাসে দাঁড়ি টেনে শান্তির বাতাবরণ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা জঙ্গলমহল ফুটবল কাপ। ব্যাপক সাড়া মিলেছিল তখনই। সেই পথ ধরেই মাস কয়েক আগে পুরুলিয়ার কাশীপুরে মহিলাদের একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় স্থানীয় বিধায়ক স্বপন বেলথরিয়ার উদ্যোগে। এবং সে বার শুধুমাত্র ওই একটি বিধানসভা এলাকা থেকেই তিনশোরও বেশি মহিলা ফুটবল দল মাঠে নামে।

Advertisement

বিপুল সংখ্যক মহিলা টিমের অংশগ্রহণ দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলেন প্রাক্তন মহিলা ফুটবল প্রশিক্ষক প্রতিমা বিশ্বাস ও রঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়। প্রতিমাদেবী বলেছিলেন, ‘‘কলকাতা থেকে এত দূরে যে ভাবে মেয়েরা মাঠে নামছে, ফুটবল খেলছে. তা বাংলার ফুটবলে কার্যত বিপ্লব।’’ সেই ‘বিপ্লব’ দেখেই কাশীপুরে মহিলা ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিছু দিনের মধ্যেই তার কাজ শুরু হওয়ার কথা। পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সম্পাদক নূরউদ্দিন হালদারের মতে, ‘‘গ্রামের মেয়েরা যাবতীয় সংস্কার বিসর্জন দিয়ে মাঠমুখো হচ্ছেন, এটাই বড় পাওনা।’’

গত বছরে পুলিশের টুর্নামেন্টেও অবশ্য যোগ দিয়েছিল মহিলাদের ৫৭টি দল। আর এখন জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকাতেও মেয়েদের ফুটবল রীতিমতো জনপ্রিয়। একদা মাওবাদী সন্ত্রাস কবলিত পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, বরাবাজার, বাঘমুণ্ডি, আড়শা, বলরামপুরের মতো এলাকার মেয়েরা ফুটবল পায়ে দাপাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর ‘ফাইভ-এ-সাইড’ বা ‘সেভেন-এ-সাইড’ টুর্নামেন্ট হচ্ছে। সেখানে আর্থিক পুরস্কারের অঙ্কটা পঁচিশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।

কী ভাবে ঘটছে এই বৈপ্লবিক বদল? কেন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে মহিলাদের ফুটবলের? প্রমীলা ফুটবল নিয়ে দীর্ঘ দশ বছর গবেষণা করছেন অধ্যাপক শুভ্রাংশু রায়। তাঁর মতে, মূলত সামাজিক বিভিন্ন অবিচারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার মানসিকতাই এর স্ফূলিঙ্গ। শুভ্রাংশুবাবু বলেন, ‘‘সকলে মিলে একটা টিম হওয়া বাড়তি মনোবল জোগায়। সেই সঙ্গে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়াটাও আছে। সেই সাতের দশকে বাংলার ফুটবলে মেয়েদের বেশি করে আসা শুরু। তখনও বাংলার উত্তাল রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা থেকে বাঁচতে ফুটবলকেই আশ্রয় করেছিলেন মেয়েরা। জঙ্গলমহল সংলগ্ন অঞ্চলে সেটাই হয়েছে।’’ শুনে মনে পড়তে বাধ্য বাংলার তারকা ফুটবলার শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার, মিনতি রায়, পরবর্তী কালে পুষ্পা দাশ, আলপনা শীলদের উত্থানের কাহিনি।

কলকাতায় মহিলা ফুটবল লিগ এখনও আছে। এক সময়ে বিভিন্ন ক্লাবে খেলে মেয়েরা চাকরি পেয়েছেন আয়কর দফতরে, পুলিশে বা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায়। এখন সেই প্রতিযোগিতায় কিছুটা ভাটার টান। কারণ, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মহিলা টিম তুলে দিয়েছে। আইএফএ-র এ সব নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। টিমটিম করে জ্বলছে দশ-বারোটা টিম। তাতেও কলকাতার ফুটবলার প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশেরই বাড়ি গ্রামাঞ্চলে।

কাজেই বাধা রয়েছে পদে পদে। কয়েক মাস আগে মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে মৌলবিদের আপত্তিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মহিলাদের ফুটবল ম্যাচ। বাঁকুড়ার ছাতনা থেকে বেশ কিছু মেয়েকে এ বার কলকাতা লিগের টিম সরোজিনীতে খেলানোর জন্য নিয়ে এসেছিলেন কোচ রত্না নন্দী। বাংলার নামী কোচ রঘু নন্দীর স্ত্রীর আক্ষেপ, ‘‘ওদের আনতে প্রচুর খরচ। আগের দিন এনে রাখতে হয়। নিরাপত্তা দিতে হয়। ভাল ভাল ফুটবলার আছে জঙ্গলমহলে। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। কিন্তু এত টাকা কোথায়?’’

তবু রুপোলি রেখাটা দেখা যাচ্ছে। কলকাতায় না হোক, প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে ফুটবল কখনও বদলের বার্তা, কখনও অভাবের সঙ্গে লড়াইয়ের রসদ। বাঁকুড়ার ছাতনার আদিবাসী তমালী ব্রজেন সংঘের কোচ ভারতী মুদি বলছিলেন তাঁর ছাত্রী তানিয়া মুদি, দুলালি বাউড়ি, পুজা মুদিদের কলকাতায় খেলে ঘরে ফেরার পরের কাহিনি। এঁরা কলকাতায় যাওয়ার সময়ে অনেকেই নাকি বলেছিলেন, ‘কী করতে যাচ্ছে কে জানে।’ বাড়ির মেয়েদের ছাড়েওনি অনেক পরিবার। কিন্তু মেয়েরা ফিরে আসার পর তাঁদের চোখ খুলে গিয়েছে।

হাসতে হাসতে ভারতী বলছিলেন, ‘‘অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ফুটবল খেলে নাম করার পর।

এই তো আমাদের সেরা গোলকিপার কল্পনা মুর্মুর বিয়ে হয়ে গেল।’’ মেগা সিরিয়ালে নয়, এ সব ঘটছে বাস্তবে, আদিবাসী এক গৃহস্থ ঘরে।

শালবনির বছর চোদ্দোর কিশোরী সঞ্চিতা মাহাতো গত বছর স্কুল ফুটবলে নজর কেড়েছিল। এ বার সুযোগ মিলেছে রাজ্য দলের হয়ে খেলার। নবম শ্রেণির এই ছাত্রীর বাবা কালোসোনা মাহাতো কাঠের কাজ করেন। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মেয়েটা ফুটবলকেই জীবন যুদ্ধে জেতার অস্ত্র করতে চায়। সঞ্চিতার কথায়, “ফুটবল নিয়ে অনেক দূর এগোতে চাই। আরও বড় হতে চাই।” মেয়ের বাবাও বললেন, “ফুটবল ওর প্রাণ। আমরা নিশ্চিত, ভাল প্রশিক্ষণ পেলে ও অনেক দূর এগোবে।”

পরিবারের এই সমর্থনটা বিরাট ব্যাপার, মানছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যার শিক্ষিকা অস্মিতা ভট্টাচার্য। তাঁর ব্যাখ্যা, “গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের মধ্যেও এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে প্রবল। পরিবার পাশে থাকায় তারা এগিয়ে আসার সাহসটা পাচ্ছে।” পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সম্পাদক সোমনাথ দাসের কথায়, ‘‘শুধু অভাবী সংসার থেকে নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও খেলতে আসছে। অভিভাবকেরা উত্‌সাহ দিচ্ছেন। এটা খুবই ভাল দিক।”

মেদিনীপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জিত তোরই এবং সন্দীপ সিংহ মানছেন, গত কয়েক বছরে জেলায় মহিলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে মেয়েরা মাঠে নামছেন। এ বার লিগ চালু হলে মহিলা খেলোয়াড়রা আরও উত্‌সাহিত হবেন মনে করছেন তাঁরা। মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক বিনয় দাস মাল বলেন, “জেলায় মহিলা ফুটবল লিগ এই প্রথম। চারটে মহকুমায় মহিলা ফুটবল লিগ হলে মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থাও মহিলা ফুটবল লিগ চালু করার সব রকম চেষ্টা করবে।”

অর্থাৎ, লড়াইয়ের আরও বিস্তৃত ময়দান পাবে সঞ্চিতা মাহাতো, সূর্যমণি মাণ্ডি, তর্জুনা মণ্ডল-রা। শাল-মহুলের ঘেরাটোপ থেকে শুরু হওয়া স্বপ্নের দৌড়টা হয়তো ছোঁবে ফ্লাডলাইট-উদ্ভাসিত কোনও অত্যাধুনিক স্টেডিয়ামকে। ফিফা র‌্যাঙ্কিং বলছে, ভারতীয় মহিলা দল এখন ৫৫ নম্বরে। আর ছেলেরা ১৪১। ঘটনাচক্রে, ভ্যাঙ্কুভারে মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল কিন্তু এই লিগ শুরুর ঠিক এক দিন পরে— ৫ জুলাই। সেই ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে’ মুখোমুখি আমেরিকা ও জাপান।

বদলের এই তো সময়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন