লোকগানের ডানায় ভর, পা মাটিতেই

দিন কয়েক আগে ফেসবুকের শেষ পোস্টে ঢাকায় ‘ভুবন মাঝি’র প্রিমিয়ারে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। যে ছবির সূত্রে তখন থেকেই কালিকার কথা-সুরে গানভাসি ও-পার বাংলা। আকস্মিক মৃত্যুর অভিঘাতেও বরাক উপত্যকার ভূমিপুত্র যেন মিলিয়ে দিলেন দুই বাংলাকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭ ০৪:০৬
Share:

মর্মাহত: কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুসংবাদে শোকের ছায়া শিলচর সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে। ছবি: স্বপন রায়

দিন কয়েক আগে ফেসবুকের শেষ পোস্টে ঢাকায় ‘ভুবন মাঝি’র প্রিমিয়ারে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। যে ছবির সূত্রে তখন থেকেই কালিকার কথা-সুরে গানভাসি ও-পার বাংলা। আকস্মিক মৃত্যুর অভিঘাতেও বরাক উপত্যকার ভূমিপুত্র যেন মিলিয়ে দিলেন দুই বাংলাকে।

Advertisement

মঙ্গলবার, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন নবান্ন-চত্বরে সদ্যপ্রয়াত শিল্পীকে সম্মাননা জানালেন, কেও়ড়াতলা শ্মশানে তাঁর সামনেই ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে কালিকার শেষকৃত্য হল। আবার বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরও তাঁর শোকবার্তায় কালিকাকে ‘বাংলা সংস্কৃতির এক প্রাণপুরুষ’ বলে বর্ণনা করলেন। মনে করালেন, ভারত ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কাজকে কালিকাপ্রসাদ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।

বরাকের লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক, গবেষক তথা গানের দল ‘দোহার’-এর মূল গায়েন কালিকাপ্রসাদ (৪৭) আমবাঙালির কাছে নিছকই প্রান্তিক স্বর নন, তা-ও বোঝা গেল এ দিন। রবীন্দ্র সদনে কালিকার দেহ যখন শায়িত, তখন অদূরেই ‘অনবদ্য শিল্পীর’ কথা বলছেন উষা উত্থুপ, লোকসঙ্গীতে কালিকার পূর্বসূরি স্বপন বসু ধরা গলায় ‘অসামান্য সংগঠক কালিকা’-র কথা মনে করাচ্ছেন। আবার চিত্রপরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বাকরহিত— ভাবতে পারছেন না, পয়লা বৈশাখ তাঁর নতুন ছবি ‘বিসর্জন’-এর মুক্তির আগেই কালিকা চলে গেলেন! ছবিতে কালিকার সুরে কৌশিকের লেখা গান, ‘যে যায় যায় রে ভাইস্যা ভাটির টানে’! ‘‘ওর জন্যই কি আমায় দিয়ে এমন গান লিখিয়ে নিল কালিকা?’’ কৌশিক ভেবে চলেছেন।

Advertisement

ক’দিন আগেই নতুন ছবি ‘রসগোল্লা’র গান রেকর্ডিং করাচ্ছিলেন কালিকা। সে-কথা বলছিলেন, জনপ্রিয় টিভি শোয়ের লোকশিল্পী জুটি গঙ্গাধর-তুলিকা। ওই অনুষ্ঠানের বিশিষ্ট মুখ কীর্তনের অদিতি মুন্সীর কথায়, ‘‘দাদা আমাদের একটা বড় গাছের মতো আগলে রাখত।’’ বলিউডের সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রের কথায়, ‘‘টিভি শোয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ও ছিল লোকগানের জলজ্যান্ত আর্কাইভ। শুধু কি বাংলার গান? মহারাষ্ট্র, রাজস্থানের গানের খবরও ওর জানা চাই!’’

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পুত্র মৈনাক বিশ্বাস যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কালিকার অন্যতম শিক্ষক। তাঁর তো মনে পড়বেই, কালিকার পারিবারিক পরম্পরা, বাবা-কাকা-পিসিদের লোকগানের প্রতি একনিষ্ঠতার কথা! ‘ভুবন মাঝি’তে কালিকার তৈরি গানে গলা লাগানো অভিনেতা পরমব্রতর গলা কাঁপছে, ‘‘শিল্পী জীবনের একটা নতুন ইনিংস শুরুর সময়েই কালিকাদা চলে গেল!’’ ক’দিন আগেই তো ঢাকায় পরমের কাছে লোকগানের একটা আলাদা মিউজিক চ্যানেল খোলার ব্যাপারে খুঁটিনাটির খোঁজ নিচ্ছিলেন কালিকা। ‘‘লোকগান ওর হাত ধরে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তার মাটির গন্ধ মাখা শব্দগুলোয় কিন্তু আপস করেনি কালিকা,’’ দেহের পিছনে শ্মশানের পথে যেতে যেতে আলোচনা করছিলেন শ্রীকান্ত আচার্য। লোকগানকে নিয়ে ডানা মেললেও তাঁর গানের দল, প্রাণের দল ‘দোহার’-কে বুকে আগলে রেখেছেন।

অনেকেরই মনে পড়ছিল, কয়েক বছরে জনপ্রিয় কালিকা ও লোপামুদ্রা মিত্রের ‘সহজ পরব’ জুড়েও লোকগানের নিজস্ব ঘরানা অটুট রাখার একরোখামি। অথচ শিবকুমার শর্মাকে ডেকে এনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে লোকগানের সেতুবন্ধেও অকুতোভয় কালিকা।

শিল্পীর স্ত্রী ঋতচেতা, ছ’বছরের মেয়ে আশাবরীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারও। কালিকাকে শুধু ‘হৃদমাঝারে’ ধরে রাখতে চান অনুরাগীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন