কাওয়াখালির জমি ফেরত নিয়ে উদ্বিগ্ন অনিচ্ছুকেরা

কাওয়াখালি উপনগরী প্রকল্পে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল এই সরকার। তিন বছর আগে এসজেডিএ’র তরফে বোর্ড মিটিং করে অনিচ্ছুকদের জমি ফিরিয়ে দিতে সম্মতিও দেওয়া হয়।

Advertisement

সৌমিত্র কুণ্ডু

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৮:৪৯
Share:

কাওয়াখালি উপনগরী প্রকল্পে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল এই সরকার। তিন বছর আগে এসজেডিএ’র তরফে বোর্ড মিটিং করে অনিচ্ছুকদের জমি ফিরিয়ে দিতে সম্মতিও দেওয়া হয়। নিয়ম মাফিক সরকারের অধিগ্রহণ করা জমি ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। তার পরেও জমি এখনও ফেরত না মেলায় উদ্বিগ্ন জমির মালিক এবং তাদের পরিবারের লোকেরা।

Advertisement

ভূমিহারাদের সংগঠনের তরফেই জানা গিয়েছে, থিকনিকাটা-কাওয়াখালি এবং পোড়াঝাঁড় এলাকায় ৫১ জন অনিচ্ছুক জমির মালিকের ৯.৩২৭ একর জায়গা রয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে হরিচাঁদ হাটের ২.১৪ একর জায়গা। হাটের ওই জায়গায় সাড়ে ছ’শো ব্যবসায়ী কারবার করতেন। তাঁরাও হাটের জায়গা ফেরত চান। সেই মতো ওই জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে এই সরকার। জমির মালিকদের একাংশের কথায়, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদ্যোগী হলেও এখনও তাঁরা জমি ফেরত না পাওয়ায় উদ্বেগ এবং চিন্তায় রয়েছেন। বেশ কয়েকজন জমির মালিক এবং হাট ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে মারাও গিয়েছেন। চিন্তায় রয়েছেন তাঁদের শরিকরাও। বর্তমান সরকারের মেয়াদও আর বেশি দিন নেই। রাজ্যে বিধানসভা ভোট আসন্ন। তার আগে জমির মালিকানা ফেরত পাবেন, এমনটাই আশা করছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে ব্যাপারে কোনও তৎপরতা না দেখে তাঁরা উদ্বিগ্ন।

এসজেডিএ সূত্রেই খবর, ২০১২ সালে ১১৪তম বোর্ড-সভাতেই অনিচ্ছুকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মতো নগরোন্নয়ন দফতরে বিষয়টি জানিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা জানতে চাওয়া হয়। ঠিক হয়, অনিচ্ছুকদের জমি ৯৯ বছরের লিজে ফেরত দেওয়া হবে। প্রকল্পের জায়গায় অনিচ্ছুকদের জায়গার সম পরিমাণ জমি সেই মতো দেওয়া হবে। কিন্তু নগরোন্নয়ন দফতরে নথিপত্র পাঠালেও সেই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে দেখে উদ্বিগ্ন জমির মালিকেরা। সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। সেই মতো দিন কয়েক আগে তাদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। এসজেডিএ’র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক আর বিমলা বলেন, ‘‘অনিচ্ছুকদের জমি আমরা ফিরিয়ে দিতে চাই বলে বোর্ড সভাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই মতো সম্মতি পেতে নগরোন্নয়ন দফতরে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশ এলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’’ সিইও জানান, সরকারের অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে কি না, বা কী ভাবে ফেরত দেওয়া হবে, তা দেখতেই নগরোন্নয়ন দফতরে পাঠানো হয়েছে।

Advertisement

এসজেডিএ-র একটি সূত্রই জানিয়েছে, নগরোন্নয়ন দফতর থেকে বিষয়টি অর্থ দফতরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফের ফাইল পাঠানো হয়েছে নগরোন্নয়ন দফতরের আইন সেলে। মাঝে এসজেডিএ-র কাছেও ফের বেশ কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়। সে সবও জানিয়ে দেওয়া হয়। ফাইল চালাচালি নিয়ে প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় উদ্বিগ্ন জমির মালিকেরা। থিকনিকাটা-কাওয়াখালি ল্যান্ড ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে মণিমোহন বিশ্বাস বলেন, ‘‘জমি এখনও ফেরত না পাওয়ায় চিন্তা তো রয়েইছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব উদ্যোগী হয়েছেন। এতদিনে জমি ফেরত পাওয়া উচিত ছিল। অথচ এখনও তা হয়নি। অনেক জমি মালিক মারাও গিয়েছেন। তাদের শরিকরাও জমি ফেরত পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।’’

অনিচ্ছুক জমির মালিকদের মধ্যে ছিলেন সুধীর দাস। তিনি ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। তাঁর ছেলেরা রয়েছেন। এক ছেলে অমৃত দাস জানান, প্রকল্পের এলাকায় বাবার বিঘাখানেক জমি ছিল। সেখানে সব্জি প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জমি না মেলায় সেই কাজ করতে পারছেন না তাঁরা। অপর ব্যক্তি কানাই অধিকারীর নামে ৬৯ ডেসিমেল জমি ছিল। কানাইবাবু মারা গিয়েছেন। তাঁর ছেলে কাজলবাবু। তিনিও মারা গিয়েছে। কানাইবাবুর স্ত্রী, পুত্রবধূ এবং দুই নাতি রয়েছেন। তাঁরাই এখন জমির মালিক। কানাইবাবু নাতিদের একজন কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘ঠাকুরদা, বাবা জমি নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন জমি ফেরতের জন্য। তাঁরা বেঁচে থাকতে পেলেন না। আমরাও সেই জমি এখনও ফেরত পাব কি না, বুঝতে পারছি না।’’

বাম জমানায় শিলিগুড়ির অদূরে কাওয়াখালিতে উপনগরী প্রকল্পে সরকারের তরফে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কাওয়াখালি এলাকায় ৩০২ একর জায়গায় উপনগরী প্রকল্প গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এসজেডিএ সূত্রেই জানা গিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে জেলাপ্রশাসন। জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং উভয় এলাকার জমি থাকায় দুই জেলা প্রশাসনের তরফে জমি অধিগ্রহণ করে তা প্রকল্পের জন্য এসজেডিএ-কে দেওয়া হয়েছিল।

অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া জোরদার হলে অনিচ্ছুক জমির মালিকেরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় তৃণমূল কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ কৃষিজমি জীবন ও জীবিকা রক্ষা কমিটির ছাতার তলায় এসে জমিহারারা আন্দোলন শুরু করেন। একাংশ কংগ্রেসের ছাতার তলায় আন্দোলনে সামিল হন। এসজেডিএ-র তরফে ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হলে অনেকে সেই সুবিধা নেন। তবে জমির মালিকদের একাংশ জমি ফেরতের দাবিতে অনড় থাকেন। সে সময় জেলা প্রশাসনের তরফে অধিগৃহীত জায়গার জন্য সরকার নির্ধারিত হারে জমির মালিকদের চেক দেওয়াও হয়। অনিচ্ছুকরা সেই অর্থ নেননি। তা জেলা প্রশাসনের কাছেই রয়েছে। গত বিধানসভা ভোটের আগে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে কাওয়াখালি উপনগরী প্রকল্পে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দেওয়া হবে। অনিচ্ছুকরা সরকারের তরফে টাকা না নেওয়ায় সেই অর্থ এসজেডিএ কর্তৃপক্ষকে তুলে দেওয়া হবে ঠিক হয়। অন্য দিকে, সেই মতো এসজেডিএ-র তরফে প্রকল্পের এলাকায় অনিচ্ছুকদের সম পরিমাণ জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজ হিসাবে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন