পরিচিত বৈষম্যের আরও একটি উদাহরণ

অভিযোগ উঠেছে, লিলুয়ায় একই পরিবারে বারবার খুন হয়েছে কন্যাসন্তানেরা। অনেকে বিস্মিত হলেও, খুব অবাক নন সমাজতত্ত্ববিদ এবং মনোবিদেরা। বরং তাঁদের মত, সমাজের চিরাচরিত বৈষম্যেরই বহিঃপ্রকাশ এই ঘটনা।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:১১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

অভিযোগ উঠেছে, লিলুয়ায় একই পরিবারে বারবার খুন হয়েছে কন্যাসন্তানেরা। অনেকে বিস্মিত হলেও, খুব অবাক নন সমাজতত্ত্ববিদ এবং মনোবিদেরা। বরং তাঁদের মত, সমাজের চিরাচরিত বৈষম্যেরই বহিঃপ্রকাশ এই ঘটনা। প্রতিটি খুনের সঙ্গে মা-ও জড়িয়ে থাকার অভিযোগ নিয়ে অবাক অনেকে। মনোবিদদের মত, অভিযুক্ত মহিলাও সেই বৈষম্যেরই শিকার। শুধু তা-ই নয়, পারিবারিক ক্ষেত্রে মহিলাদের অনেকেই যে এখনও স্বাধীন মতামত পোষণের জায়গায় থাকেন না, সেই বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে মনে করেন মনোবিদেরা।

Advertisement

শিশুকন্যাকে খুনের ঘটনায় পরিবারের হাত থাকার অভিযোগ অবশ্য বিরল নয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে একটি ঘটনায় শিউরে উঠেছিল রাজ্য। জ্বর, সর্দি নিয়ে ভর্তি একটি শিশুর শরীরের ভিতরে একাধিক সূচ দেখতে পান চিকিৎসকেরা। এসএসকেএম হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে সাতটি সূচ বার করা হলেও বাঁচানো যায়নি শিশুটিকে। সেই ঘটনায় জানা যায়, তার মা ও মায়ের প্রেমিক মিলেই শিশুটিকে খুনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। গত বছর হরিদেবপুর এলাকাতেও কন্যাসন্তানকে খুন করে বিস্কুটের পেটিতে লুকিয়ে রেখেছিল এক দম্পতি। পরে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। গত অক্টোবরে বারাসতের কালিকাপুরেও এক শিশুকন্যার মৃত্যুর পিছনে বাবা-মায়ের হাত থাকার অভিযোগ উঠেছিল।

সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ বলছেন, অনেক সময়েই তুলনামূলক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের লোকেরা কন্যাসন্তানকে এ‌খনও বোঝা বলেই মনে করেন। বেশ কিছু ধনী পরিবারেও কন্যাসন্তানের থেকে পুত্রসন্তান বেশি প্রাধান্য পায়। সেখানে শিশুকন্যাকে এ ভাবে মেরে ফেলার উদাহরণ তুলনায় কম থাকলেও গঞ্জনা এবং বৈষম্য কিন্তু পদে পদে সইতে হয়।

Advertisement

তবে লিলুয়ার ঘটনাটি অন্য বহু ঘটনার থেকে আলাদা বলেই মনে করছেন তাঁরা। কারণ, এ ক্ষেত্রে বারবার খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং চুপিসারে সেই শিশুদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পরিবারটির সামগ্রিক অপরাধপ্রবণতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বারবার একই ভাবে সন্তানদের খুন করার পিছনে কী ভাবনা রয়েছে, তা নিয়েও চিন্তা প্রকাশ করলেন তাঁরা।

মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের অভিমত, এখনও সমাজের একটি বড় অংশে মহিলারা স্বাধীন ভাবে মতামত দানের সুযোগ পান না। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও ওই শিশুদের মায়ের ভূমিকা বিশ্লেষণের জন্য শ্বশুরবাড়িতে ওই মহিলার স্থান কী ছিল, তা দেখতে হবে। এমন হতেই পারে যে, নিরুপায় হয়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পরিজনেদের কাজকর্ম নীরবে মেনে নিয়েছেন তিনি। এমনও হতে পারে, তিনি নিজেও ছোট থেকেই মেয়ে হওয়ার গঞ্জনা শুনে বড় হয়েছেন। ফলে নিজের যাদের জন্ম দিচ্ছেন, তাদের আর সে রকম জীবন দিতে চাননি তিনি।

মনোবিদ বহ্নিশিখা ভট্টাচার্যের আবার বক্তব্য, আর্থিক ভাবে হয়তো এই মা স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল। তাই বাকিরা যখন কন্যাসন্তানদের রাখতে চাননি, তিনিও সেই বাড়ি থেকে সরে গিয়ে আলাদা ভাবে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার উপায় বার করতে পারেননি। তবে বহ্নিশিখা এটাও বলছেন, ‘‘পুত্রসন্তান এখনও অনেকের মানসিকতায় ক্ষমতায়নের স্বীকৃতি। সেখানে মাতৃত্বের আনন্দ থেকে ছেলের মা হওয়া অনেক বেশি গর্বের। এ ক্ষেত্রেও পুত্রসন্তান চেয়ে মহিলার বারবার সন্তানসম্ভবা হওয়া সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশও মহিলাকে সেই দিকে আরও ঠেলে দিয়ে থাকতে পারে। তাই হয়তো বারবার নিজের সন্তানদের খুন হতে দেখেও কোনও আবেগ সে ভাবে কাজ করেনি।’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা সুস্মিতা ভট্টাচার্যের ধারণা, এ ক্ষেত্রে বাবা-মা মিলে এই কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, না হলে বারবার এক ঘটনা ঘটা সম্ভব নয় বলে মত তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘এখন কন্যাসন্তানের জন্য সরকারি নানা সুবিধা আছে। হয়তো ওঁরা সেগুলি জানতেন না। তা ছাড়া, অনেকে এখনও ভাবেন পুত্রসন্তান ছাড়া বংশরক্ষা হবে না। এঁরাও হয়তো সেই মনোভাবের শিকার।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন