ভয়ার্ত: এখনও মায়ের কোলেই সিঁটিয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
কিছুতেই কিছু হচ্ছে না এখন। গান-সিনেমা-খেলনা-পুতুলে ভোলানো যাচ্ছে না তাকে। শুক্রবার হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরা ইস্তক খাওয়া-শোওয়া দূরে থাক, স্রেফ মাকে জাপ্টে বসে আছে একরত্তি মেয়েটা।
গত ১৮ নভেম্বর জন্মদিন ছিল জিডি বিড়লার পড়ুয়া ওই শিশুটির। এখনও ঘরময় খেলনা-পুতুলের ছড়াছড়ি। মেয়েকে শান্ত করতে তার সব থেকে আদরের বার্বি পুতুলটি জোর করেই হাতে তুলে দিয়েছিলেন মা। ওষুধ আনতে কয়েক মিনিটের জন্য উঠে ফের মেয়ের কাছে এসেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ! শিউরে উঠে মা দেখেন, পুতুলের জামা খোলা, মাথা মোচড়ানো! আর তার ঠিক পাশেই রাখা স্পাইডারম্যানের মুখোশ!
আরও পড়ুন: অভিযোগ মানছেন না দুই শিক্ষক
স্কুলের বাথরুমে সদ্য ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনার অভিঘাত এ ভাবেই ফিরে ফিরে আসছে, শিশুটির ক্ষতবিক্ষত নরম মনে ছাপ ফেলছে। মনোরোগের চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘ওইটুকু বাচ্চা তো সব কষ্ট গুছিয়ে বলতে পারে না! কিন্তু ওর হাবভাব, পুতুলখেলার ধরনেও সেই কষ্টটা বেরিয়ে আসছে।’’ তবে চাপা কষ্ট ভেতরে আটকে থাকার চেয়ে আভাসে-ইঙ্গিতে এটুকু বলে উঠতে পারাটাই ইতিবাচক দিক বলে মনে করছেন জয়রঞ্জনবাবু।
শনিবার বাবা কোর্টে গিয়েছিলেন। আর মা বাড়িতে মেয়েকে সারা ক্ষণ আগলে। তিনি বলছিলেন, ‘‘বহু সাধ্যসাধনা করে ওকে একটু কেক খাওয়াতে পেরেছি, জল পর্যন্ত খেতে চাইছে না! প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে পারে ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে।’’ কচি গলা মাঝে মাঝে শুধু বলে উঠছে, ‘‘বাবা ওই দুষ্টু লোকেদের ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে দেবে তো?’’
প্রিয় সিনেমা সলমন খানের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর ছোট্ট শাহিদাকে একবারটি দেখালেই আগে চটপট ভাত খেয়ে ফেলত দস্যি মেয়ে! এখন স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ফিরেও তাকাচ্ছে না। পাড়ায় নাচগানে উৎসুক, স্কুলের দিদিদের কোলে কোলে ঘোরা মিশুকে হাসিখুশি শিশুর মন থেকে এই অদৃশ্য দেওয়াল কী ভাবে ভাঙা সম্ভব, প্রশ্নটা কুরে কুরে খাচ্ছে মা-বাবাকে! মনোবিদদের মতে, শিশুটি শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেই তাকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরাতে হবে। কারও মনে পড়ে যাচ্ছে, লাতুরের ভূমিকম্পের পরে আতঙ্কগ্রস্ত বাচ্চাদের জন্য ধ্বংসস্তূপের পাশেই ছাউনি খাটিয়ে স্কুল চালু করা হয়েছিল। স্বাভাবিক রুটিনে ফেরানোর এই চেষ্টা ছোটদের আতঙ্ক কাটাতে কাজে আসে!
জয়রঞ্জনবাবুর মতে, শিশুটির ক্ষেত্রে আর একটি আশার দিক হল তার মা-বাবার ভূমিকা। ‘‘মা-বাবা ওর সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন।’’ মেয়েটির বাবা বলছিলেন, ‘‘সাড়ে সাত মাসে কম ওজন নিয়ে জন্মানো মেয়েকে সামলানো বেশ ঝক্কির ছিল! ওর হার্টের ফুটো সারানোর চিকিৎসা দশ বছরের আগে হবে না, বলেছিলেন ডাক্তারবাবুরা। কিন্তু কোনও কষ্ট ওর খুশি কেড়ে নিতে পারেনি!’’ সেই মেয়ের থম মেরে যাওয়াটাই এখন যন্ত্রণা মা-বাবার জন্যও।