মলয় মুখোপাধ্যায়ের ছেলে শুভাশিসবাবুর সঙ্গে তদন্তে আসা পুলিশ। সোমবার, নিউ আলিপুরে। নিজস্ব চিত্র
নিউ আলিপুরের বৃদ্ধ খুনের ঘটনায় পরতে পরতে শুধু রহস্যের প্যাঁচ! যার উত্তর পেতে হন্যে লালবাজারের দুঁদে গোয়েন্দারাও। বৃদ্ধ মলয় মুখোপাধ্যায়ের দেহ উদ্ধারের ৪৮ ঘণ্টা পরেও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা যায়নি বলেই পুলিশের দাবি। খুনের কারণ নিয়েও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না লালবাজারের কর্তারা।
আরও পড়ুন: সম্পর্ক ঘিরে বচসা, সরোবরে ঝাঁপ প্রেমিকের
রবিবার নিউ আলিপুরের ও-ব্লকের ৬৫৪ নম্বর রোডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার মলয় মুখোপাধ্যায়কে বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন আয়া কবিতা দাস। তিনিই ওই বাড়িতে থাকা বৃদ্ধের ছেলে ও পুত্রবধূকে খবর দেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছিল, বৃদ্ধের ঘর থেকে দু’টি মোবাইল ও একটি অ্যাটাচি খোয়া গিয়েছে।
রহস্যধাম: মলয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।নিজস্ব চিত্র
ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে মলয়বাবুকে। শনিবার রাত ২টো থেকে রবিবার ভোর পাঁচটার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে। খাটের তলা থেকে একটি সাড়ে তিন ফুটের লম্বা রবার ব্যান্ড মিলেছে। ওই বাড়িতে কিছু দিন আগেই পুরনো সব জানলা বদলে স্লাইডিং জানলা বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। ওই রবার ব্যান্ড সেই কাজের জন্যই আনা হয়। তা দিয়েই বৃদ্ধের শ্বাসরোধ করা হয়েছে বলে সন্দেহ পুলিশের।
বৃদ্ধের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার কারণ কী, সেটাও দেখছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বলছেন, বৃদ্ধের গলায় কোনও ফাঁস দেওয়ার চিহ্ন মেলেনি। তবে প্রাণ বাঁচাতে আততায়ীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছিলেন বৃদ্ধ। তার চিহ্ন দেহে রয়েছে। আততায়ীরা একাধিক ছিল বলে প্রায় নিশ্চিত তদন্তকারীরা।
ধোঁয়াশা কোথায়
•
তিনটি টুপি বাগানে এল কী ভাবে?
•
কী ছিল সুটকেসের মধ্যে? দলিল-দস্তাবেজ?
•
নিছক ডাকাতির জন্যই খুন, না অন্য কিছু?
•
সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনও বিরোধ আছে কি?
•
আততায়ী বা আততায়ীরা কি মলয়বাবুর পরিচিত?
•
কেন আওয়াজ পাননি পাশের বারান্দায় থাকা পরিচারিকা?
•
জানলার কাজের মিস্ত্রিরা কি কিছু জানেন?
•
বাইরের ভিজে মাটিতে পায়ের ছাপ নেই কেন?
•
পিছনের ঘোরানো সিঁড়িতে কাদের পায়ের ছাপ?
•
ঘর লন্ডভন্ড করে কে বা কারা কী খুঁজেছে?
অ্যাটাচি ও মোবাইল খোয়া গেলেও, খুনের উদ্দেশ্য লুঠ কি না, তা এখনও সাফ নয় তদন্তকারীদের কাছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, অ্যাটাচিতে মূল্যবান কিছু ছিল বলে মলয়বাবুর ছেলে ও পুত্রবধূ জানাতে পারেননি। ঘরের কোথাওই মূল্যবান কিছু ছিল না। তা হলে সরাসরি আততায়ীরা বৃদ্ধের ঘরে হানা দিল কেন? কেনই বা ঘর লন্ডভন্ড করা হল? এক কর্তার প্রশ্ন, ‘‘তদন্তের মোড় বিপথে ঘোরাতেই অ্যাটাচি-মোবাইল চুরি হয়নি তো?’’ তবে কি এমন কিছু ছিল, যার দাম বেশি না হলেও সম্পত্তির নিরিখে তা গুরুত্বপূর্ণ? এ কথা ভাবাচ্ছে পুলিশকে।
মলয় হত্যা-রহস্য
কী পেলেন গোয়েন্দারা
•
খুন রাত ২টো থেকে ভোর ৫টার মধ্যে।
•
শ্বাসরোধ করে খুন।
•
খুনের অস্ত্র স্লাইডিং জানলার রাবার ব্যান্ড।
•
জড়িত একাধিক ব্যক্তি।
•
বাধা দিয়েছিলেন মলয়বাবু।
•
তাঁর শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন।
•
আঘাত থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়।
•
দু’টি ঘর লন্ডভন্ড করে কিছু খুঁজেছে আততায়ীরা।
•
উধাও তালাবন্ধ অ্যাটাচি।
•
মিলছে না দুটি কম দামি পুরনো মোবাইলও।
আততায়ীরা কী ভাবে বাড়িতে ঢুকল, তা নিয়েও রয়েছে ধন্দ। মলয়বাবুর বাড়ির পিছনে একটি লোহার সিঁড়ি রয়েছে। সেটিতে পায়ের ছাপ মিলেছে। কিন্তু তা আততায়ীদের পায়ের ছাপ কি না, এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ। পুলিশ জানায়, দোতলার পিছন দিকে বারান্দার তারের জাল কাটা ছিল। বসার ঘর লাগোয়া একটি দরজার তালা ভাঙা ছিল। কিন্তু তা ভেঙেই আততায়ীরা ঢুকেছিল, নাকি তদন্তের মোড় ঘোরাতে সেটিও সাজানো, তা স্পষ্ট নয়। তদন্তকারীদের একাংশ জানান, মলয়বাবু টুপির ব্যাপারে শৌখিন ছিলেন। খুনের পরে বাড়ির পাশে বাগানে মলয়বাবুর তিনটি টুপি পড়ে ছিল। পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে সেটিও আততায়ীরাই ছক করে ফেলে গিয়েছিল, নাকি এর পিছনে কারও কোনও রাগ কাজ করেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বাগানে ফেলে দেওয়া হয়েছে এই তিনটি টুপি। নিজস্ব চিত্র
সব দেখে পুলিশের মত, আততায়ীরা মলয়বাবুর পরিচিত। ধস্তাধস্তি হয়েছে মানে মলয়বাবুর ঘুম ভেঙে হয়তো খুনিদের চিনেও ফেলেছিলেন। জানলার কাজ করছিলেন যে মিস্ত্রিরা, তাঁদের জেরা করতে চাইছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কোনও ডাকাতদল বাড়িতে ঢুকেছিল কি না, দেখা হচ্ছে। মলয়বাবুর আয়া কবিতা দাস এবং তাঁর ছেলে তারককে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের কথায় তেমন অসঙ্গতি নেই বলেই দাবি পুলিশের। সোমবার নিউ আলিপুরের বা়ড়িতে যান ডিসিডিডি (স্পেশ্যাল) রূপেশ কুমার-সহ হোমিসাই়ড ও চুরি দমন শাখার অফিসারেরা। নিউ আলিপুর থানার পুলিশও সেখানে ছিল। লালবাজারের খবর, ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করা হচ্ছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে মলয়বাবুর ফোনের কললিস্টও। তবে লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখনও এত ধোঁয়াশা রয়েছে, যে আমরা কার্যত অন্ধকারেই।