৯০-য়েই কি আউট হবে ‘তিন নম্বর’

গ্যালিফ স্ট্রিট হয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ ধরে ‘তাকে’ আসতে দেখে তখন অপেক্ষারত যাত্রীদের মধ্যে তুমুল ব্যস্ততা। স্টপে থামতেই দ্রুত তাতে উঠে আসন দখলের তাড়া পড়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:১৩
Share:

পড়ন্ত: যাত্রীর প্রতীক্ষায় বসে মালিক ও চালক।

বাগবাজারে রাস্তার ধার ঘেঁষে তখন অন্য কয়েকটি রুটের বাস দাঁড়িয়ে। শীতের বিকেলে চাদরে নাক-কান ঢাকা মধ্যবয়স্কা সেখানে গিয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘‘এই বাস সরাও, বাস সরাও। ৩ নম্বর আসছে!’’

Advertisement

গ্যালিফ স্ট্রিট হয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ ধরে ‘তাকে’ আসতে দেখে তখন অপেক্ষারত যাত্রীদের মধ্যে তুমুল ব্যস্ততা। স্টপে থামতেই দ্রুত তাতে উঠে আসন দখলের তাড়া পড়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে। তবে ৩ নম্বরের জন্য এ হেন দৃশ্য আর কত দিন, সেই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে নিত্যযাত্রীদের।

বাসমালিকদের আশঙ্কা, ৯০ বছরের পথ চলা থামিয়ে খুব দ্রুত বন্ধ হতে চলেছে ৩ নম্বর রুটের বাস। সেই সঙ্গে শেষ হওয়ার মুখে শহর কলকাতার আরও এক ঐতিহ্য। কারণ, ৬৯টি থেকে ৩ নম্বর বাসের সংখ্যা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র চারটিতে! যাত্রী তো নেই-ই, তার উপরে অটো-টোটোর সঙ্গে লড়াইয়েও পেরে উঠছে না পুরনো কলকাতার এই নস্টালজিয়া! বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত যে চারটি বাস আজ গুটিগুটি পথে নামে, তারাও অদূর ভবিষ্যতে ‘কাটাই ঘরে’ যাওয়ার অপেক্ষায়। সরকারি নিয়ম মেনে তাদের ১৫ বছরের পথ চলার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে আর মাত্র এক-দু’বছরের মধ্যেই।

Advertisement

১৯২৮ সালে শ্রীরামপুর থেকে হাওড়ার বালি খাল পর্যন্ত পথ চলা শুরু ৩ নম্বর রুটের। কয়েক বছরে এই যাত্রাপথ দৈর্ঘ্যে বেড়ে হয় ডানলপ পর্যন্ত। তারও পরে রুট বেড়ে দাঁড়ায় গ্যালিফ স্ট্রিট লাগোয়া খালপাড় পর্যন্ত। ফলে শ্রীরামপুর থেকে বাগবাজার— প্রায় ২৪ কিলোমিটার পথ এখনও প্রতিদিন পাড়ি দেয় এই ৩ নম্বর। বাসমালিকেরা বলছেন, ২০০২ সালে ৩ নম্বর বাসের সংখ্যা ৫১ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯। সল্টলেকের অফিসপাড়া পর্যন্তও যাওয়া শুরু করে এই রুটের ১৯টি বাস। তবে সে সব আজ অতীত।

এই রুটের বাসমালিক সুদীপ গোস্বামী জানাচ্ছেন, এখন শ্রীরামপুর থেকে সকাল ৮টায় বাস ছাড়ে। সকাল সাড়ে ৯টায় বাগবাজারে সেই বাস পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গেই ফেরে শ্রীরামপুরের দিকে। সারা দুপুর শ্রীরামপুরে বসে থেকে ফের বিকেল সাড়ে ৫টায় বাগবাজারে আসে বাস। ফেরার পথে সঙ্গী হন হাতে গোনা কয়েক জন যাত্রী। সুদীপবাবুর কথায়, ‘‘দেড় ঘণ্টার এই রাস্তা অটো-টোটোয় অনেক কম সময়ে সেরে ফেলছেন যাত্রীরা। ভাড়া একটু বেশি লাগে বটে, তবে সময় বাঁচে। মানুষের যে এত সময় নেই!’’ জানাচ্ছেন, কোনও ভাবে বালি খাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেই টোটোর ছড়াছড়ি। সুদীপবাবুর আক্ষেপ, এই টোটো রাজের যুগে বাসযাত্রায় বেশি সময় ব্যয় করতে রাজি নন যাত্রীরা। আগামী জানুয়ারিতেই ‘কাটাই ঘরে’ যাওয়ার কথা তাঁর বাসের। রুটের যা অবস্থা, তাতে নতুন করে আর বাস কেনার ঝুঁকি নিতে পারছেন না তিনি।

বহু দিন ধরে বাসভাড়া বৃদ্ধি না হওয়াকেই দায়ী করছেন আর এক বাসচালক। এত দিন কোনও মতে ভর্তুকিতে বাস চালানো ওই ব্যক্তির প্রশ্ন, ‘‘নতুন বাস নামালে কি মাসের কিস্তি উঠবে?’’ তাঁর দাবি, ‘‘সরকার ১৫ বছরের বেশি বয়সি বাস তুলে দেওয়ার নিয়ম বদলাক। আর নয়তো ভাড়া বাড়িয়ে আমাদের বাঁচাক।’’

বাসমালিক সংগঠনগুলির দাবি, এই একই কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে ৭৬, ৭৯, ৭৯সি, ৮৯-এর মতো বেশ কিছু রুটের বাস। কোনওটির পথচলা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, কোনওটির ষাটের দশকে। কোনওটি হাসনাবাদ থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত যেত, কোনওটি চলত কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার থেকে বাবুঘাট। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, ‘‘সরকার আমাদের দেখে না। ভাড়া বাড়ে না। কিন্তু তেলের দাম বাড়ে। যাত্রীদেরও আজ অত সময় নেই।’’

শীতের প়ড়ন্ত বিকেলে ৩ নম্বর বাসের অপেক্ষায় থাকা এক যাত্রী রবীন রায় বলেন, ‘‘আজ হাতে অনেক সময় রয়েছে। তাই ভেঙে ভেঙে না গিয়ে ৩ নম্বর বাসে বসেই কোন্নগরে যাচ্ছি। না হলে অত সময় কোথায়?’’ আর এক যাত্রী জানাচ্ছেন, ডানলপ পর্যন্ত ৩ নম্বরে গিয়ে কোন্নগর পর্যন্ত বাকি পথ যাবেন ‘শর্টকাটে’। তবে শ্রীরামপুরে মেয়ের বাড়ি যেতে আজও ৩ নম্বরেই ভরসা রাখেন কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এই রুট মরে গিয়েছে। তবে যত দিন চলবে, তত দিন এই বাসেই যাব।’’

তার পরে? স্ট্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার মুখে প্রশ্নটায় নতুন করে হেডলাইটের আলো প়ড়ল। সেঞ্চুরি ছুঁতে এখনও দশ বছর বাকি। তবে কি ৯০য়েই আউট হবে ‘৩’?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন