মায়ের হাত শেষ পর্যন্ত ধরে থাকলে কী হত, বলা যায় না। কিন্তু আচমকা সেই হাত ছেড়ে আগে লাইন পেরোতে গিয়ে ট্রেনের তলায় চলে গেল শিশুটি।
ট্রেনের ধাক্কায় সাড়ে চার বছরের শিশুটির মৃত্যুর জেরে প্রায় চার ঘণ্টার অবরোধে ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে গেল শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখায়। আটকে পড়লেন হাজার হাজার যাত্রী। বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটের ঘায়ে জখম হলেন ডাউন বনগাঁ-ক্যানিং লোকালের বেশ কিছু যাত্রী। আটকে পড়া যাত্রীদের বক্তব্য, পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে না-থেকে একটু আগে কড়া হলে অত ক্ষণ অবরোধ চলত না।
শুক্রবার দুপুরে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে বাগজোলা খালের উপরে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, মৃতের নাম ঋষভ সাউ। তার বাড়ি দমদমের মধুগড়ের ঘেঁষের মাঠ এলাকায়। বেলা দেড়টা নাগাদ ডাউন বনগাঁ-ক্যানিং লোকাল যখন দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের দিকে আসছিল, সেই সময় বাগজোলা খালের উপর দিয়ে মায়ের সঙ্গে লাইন পেরোচ্ছিল ঋষভ। হঠাৎই মায়ের হাত ছেড়ে এগিয়ে যায় সে। ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
রেল সূত্রের খবর, শিশুটিকে বাঁচাতে ট্রেনচালক শেষ পর্য়ন্ত চেষ্টা করেছিলেন। শিশুটি হঠাৎ লাইনের উপরে এসে পড়ায় তিনি ব্রেক কষেন। কিছু দূর এগিয়ে ট্রেন দাঁড়িয়েও যায়। কিন্তু তত ক্ষণে দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, চালকের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
শিশুটি কাটা পড়তেই আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসে ট্রেনটিকে আটকে দেন। শুরু হয় পাথর-বৃষ্টি। ইটপাথরের ঘায়ে ট্রেনের জানলার কাচ ভেঙে যায়। যাত্রীরাও অল্পবিস্তর চোট পান। জনতা মারমুখী হয়ে ওঠায় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনেকে ভয়ে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন। ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন অনেক মহিলা। সব মিলিয়ে ট্রেনটিকে ঘিরে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়। মৃতদেহ আটকে রেখে বিক্ষোভকারীরা রেল অবরোধ শুরু করেন। বনগাঁ শাখায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধ চলে প্রায় চার ঘণ্টা। ফলে ওই শাখায় বহু লোকাল ট্রেন বাতিল করতে হয়।
পুলিশ অনেক পরে আসে বলে অভিযোগ। প্রথমে বিক্ষোভকারীদের বাধায় মৃতদেহ তুলতে পারেনি তারা। পরে আরও পুলিশ পৌঁছে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। গোলমালে দিশাহারা ট্রেনযাত্রীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপদ জায়গায়। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মৃতদেহটিও।
সতর্কতার কমবেশি ব্যবস্থা থাকলেও লোকজন কখনও অভ্যাসে, অনেক সময়েই নিরুপায় হয়ে হেঁটে লাইন পেরোতে বাধ্য হন। কারণ, রেললাইন পারাপারের জন্য উড়ালপুল থাকে না অনেক জায়গাতেই। এ দিন যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রেললাইনের দু’দিকে দু’টি জনবসতি রয়েছে। এক দিকে মধুগড়, অন্য দিকে সুভাষনগর। বেআইনি জেনেও ওই দু’টি এলাকার বাসিন্দারা লাইন পেরিয়েই যাতায়াত করেন। কারণ, ওখানে ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নেই। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পারাপারের নিরাপদ ব্যবস্থা করার জন্য বহু বার দাবি জানানো হয়েছে। কেউ কর্ণপাত করেনি। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজ বলেন, ‘‘এ দিন বিক্ষোভকারীরা ওই এলাকায় একটি আন্ডারপাস গড়ার দাবি জানিয়েছেন।’’
এ দিনের দুর্ঘটনার পরে মধুগড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ভিড় ভেঙে পড়েছে মৃতের বাড়িতে। ঋষভের মা মীরাদেবী প্রলাপ বকছেন, তাঁর একমাত্র ছেলে কেন হঠাৎ হাত ছেড়ে চলে গেল? বারবার বলছেন তিনি, ‘‘ও বড় চঞ্চল ছিল।’’