খোলা পড়ে রসায়নের বই, ঝুলছে কিশোরের দেহ

পরিবারের বক্তব্য, পড়াশোনায় তুখোড় সৃজন কেন আত্মহত্যা করল, তা নিয়ে তাঁরা অন্ধকারে। পুলিশ জানিয়েছে, সৃজনের ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার ছিল।’ সাত বছর ধরে চিকিৎসা চলছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৭ ০২:৫৫
Share:

সৃজন চৌধুরী

ছোট্ট ঘর। খাট থেকে কয়েক হাত দূরে টেবিলে খোলা রসায়নের বই। তার উপরে চশমা। ইতিউতি ছড়িয়ে চকোলেটের প্যাকেট। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলছে বছর সতেরোর কিশোর। সোমবার রাত দশটা নাগাদ এই অবস্থাতেই উদ্ধার হল সাউথ পয়েন্ট স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সৃজন চৌধুরী। হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, এটি আত্মহত্যা।

Advertisement

পরিবারের বক্তব্য, পড়াশোনায় তুখোড় সৃজন কেন আত্মহত্যা করল, তা নিয়ে তাঁরা অন্ধকারে। পুলিশ জানিয়েছে, সৃজনের ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার ছিল।’ সাত বছর ধরে চিকিৎসা চলছিল। এ থেকে অবসাদ আসতে পারে। এ নিয়ে কিছু বলেনি সৃজনের পরিবার। মা শুক্লা চৌধুরী মেট্রো রেলের কর্মী। বাবা সুব্রত চৌধুরী সিইএসসি-র ইঞ্জিনিয়ার।

এ দিন সৃজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয়দের ভিড়। দিদিমা শোভা মুখোপাধ্যায় বারবার বলছেন, ‘‘মৃত্যুর পিছনে অন্য কারণ আছে।’’ মা শুক্লাও তা সমর্থন করছেন। তাঁদের বক্তব্য, গত বুধবার লুকিয়ে একটি ইংরেজি ভূতের সিনেমা দেখতে গিয়েছিল সৃজন। ‘অ্যানাবেল’। তা দেখার পরেই বদলে যায় তার আচরণ।

Advertisement

আরও পড়ুন: মেয়র আজ হাজিরা দেবেন কি, জল্পনা

শোভাদেবী জানান, তিনিই রোজ সৃজনকে স্কুলে পৌঁছে দিতেন ও নিয়ে আসতেন। বুধবারও স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছিল সৃজন। হঠাৎ দিদিমাকে বলে, ‘‘আমার বন্ধুরা আজ একটা সিনেমা দেখতে যাবে। ওটা দেখলেই সবাই আত্মহত্যা করে।’’ চমকে গিয়ে দিদিমা জানতে চান, ‘‘তুই যাচ্ছিস না তো?’’ সৃজন বলেছিল, না, সে স্কুলেই যাবে। সৃজনকে স্কুলে দিয়ে আসেন শোভাদেবী। কিন্তু তাঁর দাবি, বাড়ি ফেরার পথে সৃজনের এক বন্ধুর অভিভাবক তাঁকে বলেন, সৃজনকে অন্য রাস্তায় দেখেছেন তিনি।

শোভা তা জানান সৃজনের মা-বাবাকে। শুক্লা বলছেন, ‘‘আমি আর ওর বাবা সে দিন স্কুলে যাই। ছুটির পরে ও স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে ভাবলাম, কোথাও ভুল হয়েছে।’’ তবে শুক্লাদেবীর দাবি, তিনি পরে খবর নিয়ে জানেন, সৃজন সে দিন স্কুলে যায়নি। কোথায় গিয়েছিল? ঠিকঠাক জবাবও দেয়নি। শোভাদেবী ও শুক্লাদেবীর দাবি, সে দিন স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার পর থেকেই অন্যমনস্ক ছিল সে। চুপচাপও।

শুক্লাদেবী জানান, সৃজন পড়া নিয়েই থাকত। জয়েন্ট ও আইআইটি-র জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিজের স্মার্টফোন ছিল না। মায়ের ফোন নিয়েই গেম খেলত। কী গেম, শুক্লাদেবী জানেন না বলেই দাবি করেন। তিনি এ-ও জানান, তিনি ঘরে ঢুকতেই ছেলে গেম লুকিয়ে ফেলেছে, এমনটাও হয়েছে বহু বার। সোমবার রাতেও সমস্যার সূত্রপাত ওই ফোনই। শোভাদেবী জানান, মোবাইল নিয়ে সন্ধ্যায় সৃজনের মা বকাবকি করে ওকে। তার পরেই সৃজন পড়তে বসবে বলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ‘‘খেতে ডাকার সময়ে দরজা খুলছিল না। ওর বাবা দরজা ভাঙতেই...’’— গলা বুজে আসে তাঁর।

তা হলে কি কোনও মারণ গেমের ফাঁদে পড়েছিল সৃজন? ওই সিনেমা থেকে কোনও ইন্ধন পেয়েছিল? নাকি কোনও বিষয়ে অবসাদে ভুগছিল সে?

পুলিশ সন্দেহ মানসিক সমস্যা। যার কথা জানত তার স্কুলও। সাউথ পয়েন্টের তরফে কৃষ্ণ দামানি বলেন, ‘‘সৃজন পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল। ক্লাসের মনিটর ছিল। কিন্তু ওর ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ ছিল, সেটা আমরা জানতাম। যদিও তা ওর আচরণে কখনও প্রকাশ পায়নি।’’

তা হলে কি এই সমস্যার সঙ্গে জুড়েছিল পড়াশোনার অত্যধিক চাপ? সৃজন যে পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকত, তা জানত তার বন্ধুরাও। তাদের মধ্যেই এক জনের পরিবার সূত্রের খবর, গত বুধবার কয়েক জন বন্ধু মিলে ‘অ্যানাবেল’ দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এক বন্ধুর বাবা ওদের সকলকে সিনেমা হলে পৌঁছে দেন। নিয়েও আসেন। সৃজনও ছিল। কিন্তু সে যে বাড়িতে মিথ্যে বলে স্কুল পালিয়ে সিনেমায় এসেছে, তা কেউই জানতেন না। প্রশ্ন উঠছে, বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে বাড়িতে মিথ্যে বলল কেন সৃজন?

সম্ভাব্য উত্তর মেলে বন্ধুমহলেই। ‘‘সব সময় পড়া। খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে বেরোনো, সিনেমা— কিছুই করত না। ওর দিদা রোজ স্কুলে পৌঁছে বসে থাকতেন। ছুটির সময়ে নিয়ে যেতেন। পড়া মুখস্থ ধরতেন। ও খুবই চাপে থাকত।’’— বলছে সৃজনেরই বন্ধুরা।

মনোবিদ অনিরুদ্ধ দেব বলছেন, ‘‘ওর ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ ছিলই। এরা এমনিতেই খুব সংবেদনশীল হয়। মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয় যখন-তখন। আত্মহত্যাপ্রবণও হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় পড়াশোনা নিয়ে অত্যধিক চাপ গভীর অবসাদ ডেকে আনতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন