Atheist Conference

সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা পরে ‘নাস্তিক সম্মেলনে’ হাজির বৃদ্ধা! আলোচনায় জুড়ে গেল জেমাইমার আবেগের কান্নাও

নাস্তিক সম্মেলনে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলে ডুবে মৃত পড়ুয়া অনামিকা মণ্ডলের মা মীনাক্ষী মণ্ডল। কিন্তু তিনি শারীরিক কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। মেয়ের মৃত্যুর পরে প্রকাশ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ী হওয়ার কথা বলছেন তিনি।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:৪৭
Share:

নাস্তিক সম্মেলনের আলোচনায় উঠল জেমাইমা রদ্রিগেজ়ের আবেগের কান্নার প্রসঙ্গ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কেউ কড়া নাস্তিক। কেউ আবার ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়বাদী। কেউ সচেতন ভাবে নিজের নামের পরে পদবি ব্যবহার করেন না। আবার কেউ হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর পরেন। এমনই বিভিন্ন মননের কয়েকশো মানুষ এক ছাদের তলায় জড়ো হলেন মঙ্গলবার। উত্তর কলকাতার রাম‌মোহন লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কলকাতা জেলার প্রথম ‘নাস্তিক সম্মেলন’। সম্মেলনে বক্তা থেকে প্রতিনিধিদের আলোচনায় ধর্মীয় জিগির, ধর্ম উন্মাদনা, মেরুকরণের ‘ক্রমবর্ধমান’ প্রেক্ষাপটে যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ের পাশাপাশিই উচ্চারিত হল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা।

Advertisement

রাজনৈতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক প্রবন্ধকার আশিস লাহিড়ীর বক্তৃতায় বারংবার উঠে এল সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ফারাকের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মানুভূতি এক জিনিস। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, অর্থাৎ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা গড়ার যে কার্যকলাপ, তা একেবারে ভিন্ন।’’ ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান দেওয়ারও সমালোচনা করা হয়েছে নাস্তিক সম্মেলনে। আশিসের কথাতেই উঠে এসেছে মেয়েদের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি হাঁকানো জেমাইমা রদ্রিগেজ়ের কান্নার প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘ক্রিকেট খেলার আগে অনেকে যজ্ঞ করেন। তার কোনও যুক্তি নেই। তার সঙ্গে ভাল খেলা, ফিটনেস বা ক্রিকেটীয় কৌশলের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু সেই ভাল খেলে জেতার পর রদ্রিগেজ়ের কান্নার মধ্যে আবেগ রয়েছে। যজ্ঞের মধ্যে উন্মাদনা রয়েছে। আর জেতার পর কান্নায় রয়েছে আবেগ।’’

নাস্তিকতা যে আবেগহীন কোনও বিষয় নয়, তা-ও প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে সম্মেলনে। নাস্তিকতা আলোচনা করতে গিয়ে গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ তোলেন আলোচক শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত। গ্যালিলিওর উপর ধর্মযাজকদের নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে কার্যত গলা বুজে আসছিল বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া শুভরঞ্জনের। সামলে নিয়েই তিনি বাংলা এবং উর্দু সাহিত্যে নাস্তিকতার দীর্ঘ ধারার কথা উল্লেখ করেন।

Advertisement

শুধু নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদীরা নন, উদ্যোক্তাদের তরফে ধর্ম সম্পর্কে সং‌শয়বাদীদেরও আহ্বান জানানো হয়েছিল। সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা-পলা পরে সেই সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন টালিগঞ্জের সূর্যনগরের বাসিন্দা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর স্বামী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন টিসকোর সিনিয়র ফার্মাসিস্ট। তিনি ঘোর নাস্তিক। কিন্তু প্রতিমা এখনও সিঁদুর, শাখা-পলা পরেন। সে সব পরে নাস্তিক সম্মেলনে কেন? প্রতিমা বললেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে কোনও পুজোআচ্চা হয় না। আমার সে সবে কোনও বিশ্বাস নেই। সিঁদুর, শাখা, পলা পরি তা আমার স্বামীও চান না। বাড়িতে পরি না। বাইরে পরি। তবে এই অনুভূতি আছে যে, পরা ছাড়তে পারলে ভাল হয়।’’

আলোচনা করছেন দেবস্মিতা। —নিজস্ব চিত্র।

এই সম্মেলনেই প্রতিমাদের সামনে ‘নাস্তিকতা এবং পুরুষতন্ত্র’ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মেয়েদের শাঁখা-সিঁদুর, কিংবা বোরখা পরতে বাধ্য করার সংস্কৃতিকে তুলোধনা করলেন দেবস্মিতা নামের এক তরুণী। যিনি নাস্তিক মঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও। শুধু তা-ই নয়, নাস্তিক ভাবনার বিভিন্ন লেখালিখি প্রকাশের জন্য তিনি এবং তাঁর স্বামী মিলে খুলে ফেলেছেন একটি প্রকাশনা সংস্থাও।

নাস্তিক সম্মেলনে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন গত সেপ্টেম্বরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝিলে ডুবে মৃত পড়ুয়া অনামিকা মণ্ডলের মা মীনাক্ষী মণ্ডল। কিন্তু তিনি শারীরিক কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে প্রকাশ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ী হওয়ার কথা বলছেন তিনি। নিজেই যোগাযোগ করেছিলেন নাস্তিক মঞ্চের সংগঠকদের সঙ্গে।

ভারতে বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী সংগঠনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সে সব থাকতেও কেন নাস্তিক মঞ্চ গড়ে উঠছে? এক আলোচক তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘‘সেই সংগঠনগুলি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় নিপীড়ন বা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও, নানা কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বিষয়ে নীরব। সেই কাজটাতেই অগ্রসর হতে হবে আমাদের।’’ আলোচনায় এ-ও উঠে এল, নাস্তিক মতাদর্শ ভারতের সংস্কৃতির শিকড়ে রয়েছে। যার অন্যতম উদাহরণ চার্বাক দর্শন।

কিন্তু তা-ও প্রশ্ন জাগে, ভারতের মতো এত ধর্ম, এত ভাষার দেশে নাস্তিকদের এ হেন উদ্যোগ কি নেহাতই শিশুসুলভ চপলতা? সম্মেলনে আসা এক তরুণ গায়ে রামধনু পতাকা জড়িয়ে আরও দুই পরিচিতকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, ‘‘আজ এই হল ভরেছে। একদিন স্টেডিয়াম ভরাব!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement