কী ভাবে ইতিহাস মনে রাখা হচ্ছে? কার ইতিহাস মনে থাকছে এবং কারটা মুছে যাচ্ছে? এমনই নানা প্রশ্ন উঠে এল মঙ্গলবার দুপুরের এক আলোচনাসভায়। এ দিন স্কটিশ চার্চ কলেজের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল অ্যালেক্সান্ডার ডাফ স্মারক বক্তৃতা ২০১৮-২০১৯। দেশভাগের ইতিহাসে নিম্নবর্ণের অবস্থান নিয়ে সেখানেই বক্তব্য রাখেন নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিহাস ও সাহিত্য কী ভাবে অধিকাংশ সময়েই বলেছে শুধু উচ্চবর্ণের মানুষের কথা এবং তারই মাঝে চাপা পড়ে গিয়েছে দলিত উদ্বাস্তুদের জীবন— তথ্য ও ব্যাখ্যায় ধরিয়ে দিলেন তিনি। বক্তার কথা এবং সভায় উপস্থিত উৎসাহীদের প্রশ্নের মাঝে উঠে এল পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জীবনের আরও একটি দিক।
দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে চর্চা নতুন কোনও বিষয় নয়। দফায় দফায় বদলেছে তার ধরন। এক সময়ে আলোচনায় মূলত গুরুত্ব পেয়েছে রাজনীতি ও তা ঘিরে তৈরি হওয়া দেশ বিভক্ত হওয়ার কারণ। স্বাধীনতার পরে সত্তর বছর পেরিয়ে সেই চিন্তা অনেকেটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন দেশভাগ সংক্রান্ত ইতিহাস ও সাহিত্যের গবেষকেরা। ইতিহাস চর্চায় জায়গা করে নিয়েছে উদ্বাস্তু জীবনের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক। ১৯৪৭ সালের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হাজার হাজার মানুষের বদলে যাওয়া জীবন ও জীবনবোধের কথা এখন অজানা নয় সমাজের।
তবে শেখরবাবু মনে করেন, এর মধ্যেও থেকে গিয়েছে অনেকটা ফাঁক। বহু জনের কথা বলা হলেও বাদ পড়ে গিয়েছেন আরও অনেকে। উচ্চবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুদের একটি বড় অংশ খুব কষ্ট করে হলেও নতুন জায়গায় জীবন গড়তে সক্ষম হয়েছেন। সর্বহারা হয়েও লেখাপড়া শিখিয়েছেন সন্তানদের। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন এই বঙ্গের অংশ। কিন্তু তাঁদের প্রায় কেউই ফিরে তাকাননি নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী মানুষগুলরি দিকে। ১৯৫০-এর পরে রোজগারে টান যত বেড়েছে, ততই ঢেউয়ের মতো দফায় দফায় এ পারে এসেছেন তাঁদের অনেকে। কোথায় গিয়েছেন তাঁরা? কোন ক্যাম্পে কী ভাবে কেটেছে তাঁদের দিন? সেখানেও কি বাড়েনি বর্ণের নিরিখে অসম্মানের ভার? জানার চেষ্টা করেছেন কি কেউ? শিক্ষিত উচ্চর্বণ শুধুই নিজেদের কথা বলেছে। সে কারণে যেন আরও বঞ্চিত হয়েছেন তথাকথিত নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুরা, মনে করান শেখরবাবু। তিনি বলেন, ‘‘ভদ্রলোক বাঙালি সমাজকে একটা কাহিনি মনে করিয়ে দিতে চাই, যা কি না অনেক দিন আগেই ভুলে গিয়েছেন তাঁরা। সেই গল্প বিশ্বাসঘাতকতার। পাঁচ বছর ধরে আমি এই কাজটাই করছি।’’ ইতিহাসে উপেক্ষিত সেই জনস্রোতই হয়ে রইল স্কটিশ চার্চ কলেজের সেমিনার হলের এই আলোচনার কেন্দ্র।