ফুটপাথের শীতে বয়ে চলে আরও একটা কলকাতা

পার্ক স্ট্রিট ফ্লাইওভারের নীচের ফুটপাথবাসীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে রাজি নন এই কড়া শীতেও। উৎসবের এই মরশুমে গভীর রাত পর্যন্ত বহু মানুষের আনাগোনা এই চত্বরে।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৩২
Share:

নিশুতি: পথই যখন ঘর। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, রাত সওয়া বারোটা। গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কুকুরটা। গায়ের উপর ছেঁড়া বস্তা চাপা দেওয়া। পাশেই গুটিসুটি আরও তিনটে রোগা চেহারা। একটাই কম্বল, ছেঁড়া। একটু দূরে আগুনের নিভু আঁচ লাল হয়ে আছে। খোলা আকাশের নীচে শীত-দৈত্যের সঙ্গে লড়াইয়ে ভরসা ওই কম্বল আর আগুনটুকু।

Advertisement

সূর্য সেন স্ট্রিট, রাত সাড়ে এগারোটা। প্লাস্টিকের উপর চট পেতে শুয়ে সারি সারি বছর সতেরোর কিশোর। গলা অবধি চাদর টানা। দু’হাতে ধরা সস্তার মোবাইল। স্ক্রিনে লাস্যময়ী বলিউড নায়িকা। নিছক বিনোদন? না কি শীত কাটানোর উষ্ণতাও?

গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের তলা, রাত দেড়টা। পথবাসীদের নিঃসাড় ঘুমের পাশেই চলছে মহারণ। দাবার বোর্ডে কাটা পড়ছে রাজা-উজির। সোয়েটার-মাফলারে শরীর মুড়ে মগ্ন দুই ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’। যেন এখনও সন্ধেই গড়ায়নি এই শহরে।

Advertisement

এখন শীতকাল, তাই জলদি রান্নার কাজ সেরে নেন উল্টোডাঙা স্টেশনের কাছে ফুটপাথের বাসিন্দা জরিনা। বাসন রেখে দেন, সকালে রোদ উঠলে ধোবেন। ‘‘আগে শুয়ে পড়তে পারলে একটু আরাম। রাত বাড়লে স্যাঁতসেঁতে প্লাস্টিকে শুতেও কষ্ট।’’— বললেন তিন সন্তানের মা। এক পাশে পড়ছে পুনম। বছর তেরোর মেয়ের চোখে এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। সকালে উঠতে কষ্ট হয়, তাই রাতেই পড়া এগিয়ে রাখা। ঠিক আমার-আপনার বাড়ির মেয়েটির মতোই। শুধু রুম হিটারের বদলে এখানে উষ্ণতা দিচ্ছে আবর্জনা-পোড়া আগুন, উজ্জ্বল আলোর বদলে জ্বলছে মোমবাতি।

বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটেও সন্ধে নামার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় কাজ গুটিয়ে শোয়ার তোড়জোড়। আগুন জ্বলে এক পাশে। তাতেই রুটি সেঁকে নেন পথের বধূরা। পাশে বড় হাঁড়িতে চড়েছে লালরঙা, ঝাল ডিমের কারি। সবাই মিলে হাত লাগানোর ছবি দেখে মনে হয়, চড়ুইভাতিতে মেতেছে পথের পরিবার-পড়শিরা।

এর মধ্যেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কেঁদে ওঠে মহাত্মা গাঁধী রোডের ফুটপাথের শিশু। বুকে জড়িয়ে আকাশের তারা দেখিয়ে শান্ত করতে চান মা। মলিন চাদরে ভাল করে জড়িয়ে নেন খুদের শরীর। ঘুম পাড়ানোর তাড়া স্পষ্ট। ভোর থেকেই যে শুরু হবে রোজকার দৌড়ঝাঁপ।

পার্ক স্ট্রিট ফ্লাইওভারের নীচের ফুটপাথবাসীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে রাজি নন এই কড়া শীতেও। উৎসবের এই মরশুমে গভীর রাত পর্যন্ত বহু মানুষের আনাগোনা এই চত্বরে। নামজাদা বারে, ডিস্কে, বড় বড় রেস্তোরাঁয় ভাগ হয়ে যায় আনন্দ, ও়ড়ে টাকা। তার ছিটেফোঁটা ফুটপাথেও পৌঁছয় বইকী! সেই অপেক্ষাতেই রাত জাগেন তাঁরা।

নাগরিক পরিভাষায় ওঁরা ফুটপাথবাসী। যদিও ওঁদের কাছে, রাস্তার পাশের উঁচু করে বাঁধানো ফালিগুলো কেবল ফুটপাথ নয়। ঘর। রান্না, খাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা, ঝগড়া, প্রেমে আর পাঁচটা ঘরের মতোই জমজমাট। সারা দিনের দৌড়ঝাঁপ শেষে যখন শহরের বেশির ভাগটাই লেপ টেনে নিয়ে আরামবন্দি, তখন এমনি করেই গল্প লেখে এই শহরের মধ্যে থাকা আর একটা কলকাতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন