ওঁদের ডিউটি শুরু সব শেষে, গানেরও ও পারে

সহকর্মীদের সেই দলটি যে তা বোঝে না, তেমনও নয়। তাই যেন আরও হাতেহাত রেখে চলেন ওঁরা। বসার ভঙ্গী বলে দেয়, একে-অপরের কাছে ভরসা খোঁজেন ওঁরা। পাশে বসে কানে ভেসে আসে তরুণীদের ফিসফিস গল্প।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৮ ০৩:০৬
Share:

সঙ্গী: শহরের ফুটপাথে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

রোজ দুপুরে মলিন সাজে মেট্রোয় উঠতে দেখা যায় ওঁদের। কেউ দমদম, কেউ বা শ্যামবাজার থেকে। তরুণীদের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার, কাঁধে বড় ব্যাগ। গায়ের জামার সঙ্গে বিশেষ মিল নেই মুখের মেক-আপের। কোথায় যান ওঁরা? দলটির আচরণ-আলোচনা বলে দেয়, কাজেই বেরিয়েছেন সকলে। কিন্তু ভরদুপুরে এমন সাজে কী কাজ? ভরা মেট্রোয় নিত্য যাত্রীদের অনেকের চোখেই দেখা দেয় তেমনই প্রশ্ন।

Advertisement

সহকর্মীদের সেই দলটি যে তা বোঝে না, তেমনও নয়। তাই যেন আরও হাতেহাত রেখে চলেন ওঁরা। বসার ভঙ্গী বলে দেয়, একে-অপরের কাছে ভরসা খোঁজেন ওঁরা। পাশে বসে কানে ভেসে আসে তরুণীদের ফিসফিস গল্প। শোনা যায় শহরতলির ঘর-সংসারের নানা কথা। কখনও সন্তান-রান্নাবান্না, কখনও বা স্বামী এবং প্রেমিকও। রোজ যাতায়াতে চেনা হয়ে যাওয়া মুখেদের ‘বিশেষ’ বন্ধুদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে মেট্রো সফরের সূত্রে। ট্রেনের কামরার এক কোণে দাঁড়িয়ে কখনও মান-অভিমান, কখনও বা তাঁদের ঝগড়া বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না বিশেষ। তারই মধ্যে শোভাবাজার থেকে ওঠা জমকালো শাড়ির বয়স্কা মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালে বদলে যায় আবহ। এ বার শুরু হয়ে যায় কাজের কথা। কাকে, কবে, কোথায় যেতে হবে— বলতে থাকেন বয়োজ্যেষ্ঠা। বাধ্য ‘ছাত্রীরা’ মাথা নেড়ে বুঝে নিতে থাকেন নিজের নিজের কর্তব্য।

তবে কি সেলস্ গার্ল ওঁরা? এক এক দিন, এক এক জায়গায় কোনও জিনিস বিক্রি করাই কাজ? তারই রুট ম্যাপ তৈরি হয় সাঙ্কেতিক ভাষায়? কিন্তু সাজ যে তা বলে না! নাকি বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন তরুণীরা? কোনও সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত কি ওঁরা? গন্তব্য অবশ্য সে ইঙ্গিতও দেয় না।

Advertisement

সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ভাঙতে শুরু করে দলটি। বড় দলটি নেমে যায় পরের স্টেশন চাঁদনি চকে। রয়ে যান আরও কেউ কেউ। আলোচনা ভেসে আসে, তাঁরা যাবেন পার্ক স্ট্রিট কিংবা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। ব্যস্ত অফিসপাড়ায় ভরদুপুরে পরিচারিকারা যাবেনই বা কেন? তা-ও এ ভাবে দল বেঁধে! মধ্যবিত্ত মনের বোঝা দায় মেট্রোয় চেনা হয়ে যাওয়া সেই তরুণীদের কাজের হিসেব।

তবে রহস্যের শেষ আছে। রাত সাড়ে ন’টা-দশটায় অফিস ফেরত হঠাৎই দেখা হয়ে যায় দুপুরের কোনও সহযাত্রীর সঙ্গে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ধারের পানশালা কিংবা ইউনিসেক্স বিউটি পার্লার থেকে বেরিয়ে আসছেন কেউ। তত ক্ষণে বদলে গিয়েছে বেশ। চুমকি বসানো সিনথেটিক শাড়ি, সঙ্গে বড়সড় পুঁতির মালা-কানের দুল। মুখের রঙে পড়েছে আরও কয়েক পোঁচ। যদিও তাতে ঢাকা পড়ে না হাত-পা-নখে অযত্নের ছাপ। বিশাল বড় গাড়িতে চড়ে, বয়সে তিনগুণ বড় পুরুষ সঙ্গীদের পাশে বসে তাঁরা চলে যান। এক এক জন, এক এক দিন, এক এক দিকে।

পানশালায় গান করেন না ওঁরা। সে কাজের জন্য আলাদা দল আসে ওই সব এলাকায়। এই তরুণীদের ডিউটি বুঝি সব শেষে, গানেরও ও পারে।

কথায় কথায় অন্য দিনের মেট্রো পথে আবারও ভেসে আসে সন্তানের স্কুলে ভর্তি, বাবা-মায়ের অসুস্থতা এবং তা ঘিরে কাজে ওভার টাইমের ভাবনা। আগের রাতের কাজ সেরে কেউ বাড়ি ফিরেছেন কাকভোরে, কেউ বা তারও পরে। ক্লান্ত চোখে তবুও সংসারের নানা স্বপ্ন। ছুটির দিনে চিড়িয়াখানা নাকি শপিং মল— ছেলের রকমারি বায়নার গল্প। হাতে তখনও বা বাড়িতে কারও জন্মদিন উপলক্ষে রান্না করে আসা মাংসের ঝোলের হলুদের দাগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন