ভর্তির ‘বাজারে’ রাজসূয় যজ্ঞ

সব চেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বিরুদ্ধে। রাতুল ঘোষ নামে এক অশিক্ষক কর্মীর খোঁজ চলছে। শেখ জসিমুদ্দিন নামে ওই কলেজের এক পড়ুয়া ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৮ ০২:৪৬
Share:

ভর্তি-জুলুমের ‘ব্লু প্রিন্ট’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল গত এপ্রিলেই! কারও উপরে দায়িত্ব ছিল, জেলা থেকে শহরের কলেজগুলিতে ছেলেমেয়েদের ‘ধরে’ আনার। কেউ আবার বিভিন্ন কলেজের ‘ভর্তি-দাদাদের’ সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব নিয়েছিল। বাকিরা টাকার বিনিময়ে শহরের বিভিন্ন হস্টেলে এবং‌ ফ্ল্যাটে প্রার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্বে ছিল।

Advertisement

ভর্তি-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমনটাই জানতে পেরেছে পুলিশ। যা শুনে তদন্তকারীরা বলছেন, ভর্তি ঘিরে এ যেন এক রাজসূয় যজ্ঞের পরিকল্পনা! প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল এক বা একাধিক ‘বিশেষজ্ঞ ভর্তি-দাদা’। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলছিল জুনের শুরু থেকেই। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো ধরপাকড় শুরু হতেই এখন বেসামাল অবস্থা। তদন্তকারীরা বলছেন, শহরের কলেজগুলিতে যেন অঘোষিত ছুটি চলছে। অভিযুক্তেরা বেশির ভাগই চলে গিয়েছে হয় দিঘা, নয় পুরী। কেউ কেউ আবার নেপালে নিজের গোপন আস্তানায় গিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে বলে খবর।

ভর্তি-জুলুম নিয়ে প্রবল ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত শুক্রবারই নেতা-মন্ত্রীদের সচেতন করার পাশাপাশি পুলিশকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। লালবাজারের তরফে হেল্পলাইন নম্বর এবং ই-মেল আইডি চালু করা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, গত এক সপ্তাহে জমা পড়া অভিযোগ ধরে ধরে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। গত সপ্তাহেই ১৭টি ডেরায় হানা দেন লালবাজারের গুন্ডা দমন শাখার অফিসারেরা। এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে আট জন। যদিও দু’জন জামিন পেয়ে গিয়েছে অভিযোগকারী অভিযোগ তুলে নেওয়ায়। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘ভর্তি ঘিরে বড় ব্যবসা শুরু হয়েছিল। সব গ্রেফতার হবে।’’

Advertisement

সব চেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজের বিরুদ্ধে। রাতুল ঘোষ নামে এক অশিক্ষক কর্মীর খোঁজ চলছে। শেখ জসিমুদ্দিন নামে ওই কলেজের এক পড়ুয়া ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে। জানা গিয়েছে, কারমাইকেল হস্টেলের আবাসিক ওই ছাত্র উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েদের ‘দায়িত্বে’ ছিল। ‘ভর্তি-দাদারা’ উত্তরবঙ্গ থেকে আসা পড়ুয়াদের তার সঙ্গেই যোগাযোগ করতে বলত। সেই সুযোগে যেমন খুশি টাকা তুলত জসিমুদ্দিন। পরে তা পৌঁছে যেত ‘ভর্তি কোষাগার’-এ। থাকা-খাওয়ারও ‘ভাল’ ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে আশ্বাস দিত জসিমুদ্দিন। রাতুলের বাড়ি থেকে আবার বেশ কিছু ভর্তি সংক্রান্ত নথি উদ্ধার করেছে পুলিশ। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ কর্তৃপক্ষ রাতুলের পাশে দাঁড়ালেও ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য তথা উত্তর কলকাতার এক যুব তৃণমূল নেতাকেও পুলিশ খুঁজছে। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি-দুর্নীতিতে সে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ।

অভিযোগের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেই একসঙ্গে রয়েছে উত্তর কলকাতার মণীন্দ্রচন্দ্র, শ্রীশচন্দ্র এবং জয়পুরিয়া কলেজ। গত সপ্তাহে গ্রেফতার হওয়া লালসাহেব গুপ্ত এবং রীতেশ জায়সবাল— দু’জনেই শ্রীশচন্দ্র কলেজের পড়ুয়া। সূত্রের খবর, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) প্রাক্তন রাজ্য নেত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই দুই ছাত্রই কলেজের অঘোষিত মাথা। উত্তর কলকাতার বাকি কলেজগুলির সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বে ছিল লালসাহেব। রীতেশ সরাসরি যোগাযোগ রাখত টিএমসিপি শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে। নিজের কলেজে ভর্তি করাতে না পারলে টাকা দেওয়া ছাত্রের জন্য অন্য কলেজে ফোন ঘোরাত লালসাহেব।

সূত্র জানাচ্ছেন, আর এক ধৃত, জয়পুরিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তিতান সাহার এমনই প্রভাব যে, জয়পুরিয়া কলেজের ওয়েবসাইটে মেধা তালিকা প্রকাশ হওয়ার আগেই তা চলে আসত তার কাছে। সে সেই তালিকা ছড়িয়ে দিত হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সেই তালিকা দেখেই এর পরে ছাত্র ‘ধরার’ কাজ শুরু করত তার সঙ্গীরা। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের কোর্স শেষ করা তিতানের একটি হুকা-পার্লার ছিল। একটি অ্যাপ-ক্যাবও রয়েছে তার মালিকানায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেত্রী এবং টিএমসিপি রাজ্য নেত্রীর ঘনিষ্ঠ তিতানের আয়ের উৎসও খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।

ভর্তি-চক্রে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে উত্তরপাড়ার প্যারীমোহন কলেজের ধৃত ছাত্র সঞ্জু সিংহ এবং শুভ্র অধিকারী। চলতি বছরেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা শুভ্রকে পড়ুয়া ধরে আনার দায়িত্ব দিয়েছিল এবিভিপি-র সদস্য সঞ্জু। বদলে শুভ্রকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা ছিল সঞ্জুর। দু’জনেই অবশ্য হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়।

তদন্তকারীরা সব চেয়ে অবাক দক্ষিণ কলকাতার সাউথ সিটি কলেজের সান্ধ্য বিভাগ, প্রফুল্লচন্দ্র কলেজের পড়ুয়া সায়ন মুখোপাধ্যায় এবং জাহির আহমেদের ‘কীর্তিতে’। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সায়ন সম্প্রতি নিজের নাম বদলে রেহান আলি হয়েছিল। রেহান নামেই তার পরিচিতি। নানা অনৈতিক কাজে একাধিক বার নাম জড়িয়েছে দু’জনেরই। ‘এডুকেশন সলিউশন’ নামে একটি ভুয়ো সংস্থা খুলে কার্ড ছাপিয়েছিল জাহিরেরা। তা দেখিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করত তারা। শহরের যে কোনও কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নাম করে জেলার পড়ুয়াদের কাছ থেকে টাকা তুলেছিল দু’জন। সম্প্রতি পুলিশ দু’জনকেই গ্রেফতার করেছে। যদিও অভিযোগকারী অভিযোগ তুলে নেওয়ায় দু’জনেরই জামিন হয়ে গিয়েছে।

এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলে জাহির বলেন, ‘‘ভুল করে আমার নম্বর ওই কার্ডে রয়েছে।’’ টাকা নেননি? প্রশ্ন শুনেই ফোন কেটে দেয় জাহির।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিনও বলেছেন, ‘‘পুলিশ তৎপর রয়েছে। আমরাও ঘুরছি। কোনও রকম দুর্নীতি মেনে নেওয়া হবে না। দোষীরা কড়া শাস্তি পাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন