Populist Politics

‘কংগ্রেসের হাতে ১৫০ বছরের ইতিহাস, আরএসএসের রসদ ৫০০০ বছরের’

ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ভারতেও এখন পুরনো ধাঁচের উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে জনপ্রিয়তাবাদী বা লোকায়তিক (Populist) রাজনীতির জয়জয়কার।

Advertisement

রজত রায়

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৫:০৪
Share:

বাঁ দিক থেকে বদ্রিনারায়ণ তিওয়ারি, সৈয়দ বদরুল আহসান এবং রণবীর সমাদ্দার। —নিজস্ব চিত্র।

গত তিন দশকে ভারত তথা বিশ্বের রাজনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে তছনছ, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি সমাজতন্ত্রের খোলস ফেলে দিয়ে আবার ফিরে গেছে ধনতন্ত্রের পথে। এমনকি, চিন মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও সব অর্থেই ধনতন্ত্রের পথে হাঁটছে। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো ভারতেও এখন পুরনো ধাঁচের উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতির বদলে জনপ্রিয়তাবাদী বা লোকায়তিক (Populist) রাজনীতির জয়জয়কার। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের লা পেন, ইংল্যান্ডের জেরেমি করবিন বা হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, এমনকি ভারতে নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরীবালরা এখন চিরাচরিত রাজনীতির পথে না হেঁটে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির সূত্রে জনতার কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন।

Advertisement

কী সেই রাজনীতি? কী ভাবেই তা চিরাচরিত ধারার বামপন্থী বা দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে পাদপ্রদীপের সামনে উঠে এল? এই রাজনীতির মূল লক্ষণগুলি কী কী? কোথায় তার শক্তি? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ক্যালকাটা রিসার্চ সেন্টার (সিআরজি)-এর উদ্যোগে সম্প্রতি একটি কনফারেন্সে অংশ নিলেন ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশের বিশেষজ্ঞ গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিকরা। রোজা লুক্সেমবার্গ ফাউন্ডেশনের আনুকূল্যে কলকাতার সল্টলেকে গত শনিবার ও রবিবার এই কনফারেন্স হয়ে গেল।

প্রথম দিন ইলাহাবাদের জিবি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বদ্রিনারায়ণ তিওয়ারি এই জনপ্রিয়তাবাদী বা লোকায়তিক রাজনীতির চরিত্রের সাধারণ ধারণা ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন— কী ভাবে আরএসএস এই রাজনীতির মাধ্যমে সমাজের নিচুতলার দলিত, আদিবাসী সমাজের মানুষকে তাদের হিন্দুত্বের পতাকার তলায় জড়ো করছে। বদ্রিনারায়ণের মতে, জনপ্রিয় (Popular) ও জনপ্রিয়তাবাদী (Populist)-এর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। রাজনীতিক মাত্রই জনপ্রিয় হতে চাইবে। তার জন্য নানা ছলচাতুরি কলাকৌশল অবলম্বনেও তার আপত্তি নেই। অন্য দিকে, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি মানুষের মধ্যে কিছু পাওয়ার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। তারা মানুষের সমষ্টিগত চিন্তার মধ্যে এই আগ্রহ জন্মাতে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং ইন্ধন জুগিয়ে চলে। এই প্রসঙ্গে তিনি ব্যাখ্যা করেন— কী ভাবে উত্তর ভারতে নিম্নবর্ণের মানুষ ও আদিবাসীদের মধ্যে আরএসএস প্রভাব বিস্তার করছে। হিন্দিবলয়ে নিম্নবর্ণের মুশায়র সম্প্রদায়ের মধ্যে সমীক্ষা চালানোর সময় তিনি দেখেছেন— বেনারসের কাছের একটি মুশায়র গ্রামকে আরএসএস অটলনগর নামকরণ করল, তার পর সেখানে মানুষের ইচ্ছাপূরণ করতে একটি মন্দির স্থাপন করল। তার মধ্যে, মুশায়রদের কুলদেবতা ‘সাবরি’র সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করল শিবলিঙ্গও। একই ভাবে, আদিবাসীদের মধ্যেও ধীরে ধীরে হিন্দু দেবতাদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। আরএসএস এখন আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের মানুষদের গ্রামে গ্রামে ‘ধর্মগ্রাম’ তৈরি করছে। সেখানে স্কুলে ধর্মশিক্ষা হচ্ছে। পাশাপাশি হাসপাতাল ও মন্দির থাকছে। রোজ ভোর সাড়ে ৪টায় মাইকে ভজনকীর্তন শুরু হয়। সরকার স্কুল ও হাসপাতাল চালাতে আর্থিক ভাবে সাহায্য করছে। কারণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকেও প্রলোভন না দেখাতে পারলে, কাজে ফল পাওয়া কঠিন।

Advertisement

আরও পড়ুন: সাড়ে ৩ ঘণ্টার বৈঠকে ‘ওভারথ্রো’ আটকালেন মুকুল, বিজেপিতেই রয়েছি, জানালেন শোভন-বৈশাখী, কাঠগড়ায় জয়প্রকাশ​

বদ্রিনারায়ণের মতে, এ ভাবে দলিতদের ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের (যেমন বৌদ্ধদের) দেবতাদেরও হিন্দুধর্মের মধ্যে নিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া, সেটাই সমাজে আরএসএসের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। তিনি মনে করিয়ে দেন, কংগ্রেসের রাজনীতির ভাষার ইতিহাস বড়জোর ১৫০ বছরের পুরনো। কিন্তু আরএসএস ৫০০০ বছরের ইতিহাস থেকে রসদ সংগ্রহ করতে পারছে। মদনমোহন মালব্য, যিনি কংগ্রেসের নেতা ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, বলেছিলেন, ভারতীয় গ্রাম তিনটি আধারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে— কথা, বিদ্যাশালা ও মধুশালা। আরএসএস নেতা গোলওয়ালকার ছিলেন মালব্যের সহপাঠী ছাত্র। তিনি এই কথার সার বুঝেছিলেন। তাই কথা অর্থাৎ কথকতার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে অতীতের লুপ্তগৌরবের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আরএসএসকে।

সম্মেলনের প্রথম দিনে অপর বক্তা ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক ও ইতিহাস চর্চার জন্য বিশিষ্ট সৈয়দ বদরুল আহসান। তিনি মূলত বাংলাদেশে মৌলানা ভাসানির কৃষক আন্দোলনের জনপ্রিয়তাবাদী ঝোঁকের ব্যাখ্যা করেন। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ১৯৪০ সালের লাহৌর সম্মেলনে জিন্নার সেই ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিপজ্জনক তত্ত্ব, যার জেরে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাংঘাতিক দাঙ্গা ও হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার প্রেক্ষিত মনে করিয়ে দেন। ফজলুর হক থেকে মুজিবুর রহমান কী ভাবে জনপ্রিয়তাবাদী লাইনে দেশের মানুষকে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তার বিবরণ দেন। পাশাপাশি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর স্লোগান ‘ইসলাম, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’ এবং সমসাময়িক কালেই ইন্দিরা গাঁধীর স্লোগান ‘গরিবি হঠাও’-এর তুলনা করে বলেন, ভুট্টোর চিন্তা ছিল ধোঁয়াশাপূর্ণ, অন্য দিকে, ইন্দিরার স্লোগান নিশ্চিত রূপেই জনপ্রিয়তাবাদী।

আরও পড়ুন: ব্যারাকপুর হিংসা নিয়ে এ বার ডিজিকে তলব করে কথা বললেন রাজ্যপাল​

সিআরজির অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দারও এই জনপ্রিয়তাবাদী বা লোকায়তিক চিন্তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পশ্চিমী দুনিয়ার প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ও ধারণার মাপকাঠি দিয়ে ভারতের মতো উত্তর ঔপনিবেশিক দেশগুলির লোকায়তিক রাজনীতিকে বোঝা সম্ভব কি না, তা এখনই বলা যায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন