ঠেলার মুখে তদন্ত কমিটি অভিজিতের

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি তাণ্ডবের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করতে সময় নিয়েছিলেন দেড় মাস। সে-রাতের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিতে আড়াই মাস লাগল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর। হস্টেলে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির তদন্ত চেয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঘেরাওয়ে বসেন এক দল ছাত্রছাত্রী। তাঁদের হাত থেকে মুক্ত হতে পুলিশ ডাকেন অভিজিৎবাবু। সেই পুলিশি তাণ্ডব নিয়ে ঘোর কলরব হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে বিদেশেও। নিজের কার্যালয়ে এখনও কার্যত একঘরে হয়েই আছেন অভিজিৎবাবু।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫৩
Share:

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি তাণ্ডবের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করতে সময় নিয়েছিলেন দেড় মাস।

Advertisement

সে-রাতের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিতে আড়াই মাস লাগল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর।

হস্টেলে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির তদন্ত চেয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ঘেরাওয়ে বসেন এক দল ছাত্রছাত্রী। তাঁদের হাত থেকে মুক্ত হতে পুলিশ ডাকেন অভিজিৎবাবু। সেই পুলিশি তাণ্ডব নিয়ে ঘোর কলরব হয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে বিদেশেও। নিজের কার্যালয়ে এখনও কার্যত একঘরে হয়েই আছেন অভিজিৎবাবু। তাঁর ইস্তফার দাবিতে অনড় পড়ুয়া এবং শিক্ষকদের বড় অংশ। কলা ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৯৭% পড়ুয়া সম্প্রতি গণভোট দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অভিজিৎবাবুকে চান না। তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অনড় শিক্ষক সংগঠন জুটা-ও। পরিস্থিতি যে কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না, তা টের পেয়েই সে-রাতের ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন অভিজিৎবাবু।

Advertisement

কয়েক জন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও শিক্ষক-ছাত্রদের বড় অংশ এতে খুশি নন। তাঁদের প্রশ্ন, ঘটনার দায় তো উপাচর্যেরই। তা হলে তাঁর গড়া তদন্ত কমিটি কী-ই বা খতিয়ে দেখবে? কতটা নিরপেক্ষই বা হবে সেই তদন্ত? ১৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে মাসখানেক আগে উপাচার্য যে-চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে সাড়া মেলেনি। তদন্ত কমিটির গড়েও খুব একটা সুবিধা হবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

উপাচার্য শুধু যে একঘরে তা-ই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁর খামতি, এমনকী তাঁর বিরুদ্ধে অন্যের গবেষণাপত্র নকল করার অভিযোগও উঠেছে। সেই অভিযোগ পৌঁছেছে আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে। আজ, বৃহস্পতিবার আচার্যের সঙ্গে অভিজিৎবাবুর দেখা করার কথা। এই পরিস্থিতিতে তদন্ত কমিটি গড়ে উপাচার্য মুখরক্ষার চেষ্টা করছেন বলে শিক্ষক-পড়ুয়াদের বড় অংশের মত। যদিও উপাচার্য তা মানতে রাজি নন।

মাসখানেক আগে শিক্ষক সংগঠন ‘আবুটা’র কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে অভিজিৎবাবু সেই ঘটনার দায়ও কার্যত স্বীকার করে নেন। এত দিন পরে তদন্ত কমিটি গড়ে কী দেখতে চাইছেন তিনি?

অভিজিৎবাবু বলেন, “এই কমিটি তো কারও বিরুদ্ধে কিছু খতিয়ে দেখার জন্য নয়। কেউ তাঁর কাজের মূল্যায়ন করতেই পারেন। এই কমিটি সেটাই করবে।” কমিটিতে কারা থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত হয়নি।

উপাচার্যের ব্যাখ্যায় শিক্ষক-পড়ুয়ারা সন্তুষ্ট নন। তাঁদের প্রশ্ন, সে-রাতে পুলিশি তাণ্ডবের পিছনে মূল ভূমিকা ছিল তো খোদ উপাচার্যেরই। তা হলে তাঁর গড়া তদন্ত কমিটি কী খতিয়ে দেখবে? কমিটি যে নিরপেক্ষ তদন্ত করবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী?

শুধু শিক্ষক বা পড়ুয়া নয়। পরোক্ষ ভাবে যাদবপুরের অনেক এমেরিটাস অধ্যাপকও অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। এমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বুধবার বলেন, “বিলম্ব হলেও উপাচার্য যদি সত্যিই তদন্ত কমিটি গড়েন, সেটা ভাল কথা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া, গবেষণার ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ আছে। উপাচার্য এগুলি নিয়েও আলোচনা করলে পারেন।” আর এক এমেরিটাস অধ্যাপক আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, “১৬ সেপ্টেম্বর রাতে যা যা হয়েছিল, এমনকী উপাচার্য কেন নিজের প্রাণসংশয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন, সব কিছুরই বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।”

উপাচার্য অবশ্য জানাচ্ছেন, বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করার এক্তিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই তদন্ত করবেন। এই তদন্তের কোনও বিধিসম্মত ভিত্তি নেই। তবে শুধু গত ১৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নয়, ২০০৫, ২০০৭ এবং ২০১০ সালে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-আন্দোলন প্রতিহত করতে পুলিশ তথা তৎকালীন কর্তৃপক্ষের কী ভূমিকা ছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।

স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হলেও শিক্ষক-ছাত্রদের বড় অংশের বিরোধিতার আবহে অভিজিৎবাবু কী ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন, আগেই সেই প্রশ্ন উঠেছে। উপাচার্যের দাবি, তিনি সকলের সহযোগিতায় স্বচ্ছন্দেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। অথচ সম্প্রতি অতিথি শিক্ষক নিয়োগে উদ্যোগী হয়েও জুটা-র বিরোধিতা এবং শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপের জেরে পিছিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে।

আবুটা ১৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনার প্রতিবাদ জানালেও অভিজিৎবাবুর পদত্যাগ চায়নি কখনওই। সেই জন্যই তিনি আবুটা-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের মাধ্যমে উপাচার্য নিজের বক্তব্য জানাচ্ছেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। যদিও অভিজিৎবাবু এ কথা মানতে চাননি। আবুটা-র আহ্বায়ক গৌতম মাইতি অবশ্য জানান, উপাচার্য তাঁদের দাবি মেনে তদন্ত কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাঁরা খুশি।

তবে শুধু ১৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনাই নয়। ২৮ অগস্ট হস্টেলে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে জেল খেটেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র। এখন তাঁরা জামিনে মুক্ত। ওই ঘটনায় এই ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল, তা-ও খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গড়া হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। আবুটা-র বক্তব্য, পুলিশের তদন্তে তাদের কোনও আস্থা নেই। তাই ওই ছাত্রেরা বিনা দোষে সাজা পাচ্ছেন কি না, তা দেখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কেই। উপাচার্য জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও শিক্ষককেই এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। সেই তদন্তে যদি দেখা যায়, এই ছাত্রেরা নির্দোষ, রাজ্য সরকারকে তা জানাবে বিশ্ববিদ্যালয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন