হওয়ার কথা ছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। কিন্তু হঠাৎ তা বদলে গেল নির্বিচার হামলায়। বাসযাত্রীদের মধ্যে দু’এক জন অবরোধ তুলে নিতে অনুরোধ করেছিলেন। আর তাতেই প্রবল ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের এলোপাথাড়ি চড়থাপ্পড় মারতে শুরু করেন বিক্ষোভকারী ট্যাক্সিচালকেরা। বৃহস্পতিবার, ধর্মতলায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সরকারকে কার্যত বোকা বানিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ট্যাক্সি নামালেন না চালকেরা। আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পাওয়ায় আচমকা আক্রমণের মুখে দিশাহারা হল পুলিশ-প্রশাসন। যার জেরে দিনভর নাকাল হলেন নিত্যযাত্রীরা। বিকেলে ট্যাক্সিচালকদের মিছিলে সিপিএম এবং বিজেপি-র শ্রমিক সংগঠনের নেতারা যোগ দেওয়ায় তা আলাদা মাত্রা নিল। ধর্মতলায় মারমুখী হয়ে উঠল মিছিল। ভাঙচুরের পাশাপাশি চড়াও হল যাত্রিবাহী বাসে। খণ্ডযুদ্ধ বাধল পুলিশের সঙ্গে।
সারা দিন এত কাণ্ডের পরেও এর কোনও সমাধানসূত্র বার করতে পারল না সরকার। বরং, প্রথমার্ধে ট্যাক্সিচালকদের কাছে গোল খেয়ে তা কী করে শোধ করা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত থাকল প্রশাসন। সন্ধ্যায় পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রর পাল্টা হুমকি, “জঘন্য ঘটনা। সরকার বরদাস্ত করবে না। ২০ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য পরোয়ানা জারি হয়েছে। যে সব ট্যাক্সিচালকেরা এ জন্য দায়ী, তাঁদের খুঁজে বার করা হবে।” এমনকী, এখনই আলোচনায় বসার কোনও পরিকল্পনাই যে নেই, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী।
অথচ, আন্দোলনকারীদের সূত্রের খবর, খোদ পরিবহণমন্ত্রীর খাসতালুকে বসেই দিনের পর দিন এত বড় অঘোষিত ট্যাক্সি ধর্মঘটের ছক কষা হয়েছিল। ধর্মঘট সফল করতে ভবানীপুর এলাকার একটি ধাবায় বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকও করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শহরের রাস্তায় ট্যাক্সি থাকবে না। সেই খবর আগে থেকে প্রশাসনকে বিস্তারিত দেওয়া হবে না। সেই মতো বেলতলায় মোটর ভেহিক্লসের অফিসে আসা ট্যাক্সিচালকদের অঘোষিত ধর্মঘটের খবর দেওয়া শুরু হয়। কলকাতা ও শহরতলি এলাকার বিভিন্ন চালকের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে খবর দেওয়া হয় কর্মসূচির। বলে দেওয়া হয়, বৃহস্পতিবার মিছিলে আসাই নয়, দিনভর ট্যাক্সিও চালানো যাবে না।
কোথাও যাওয়ার নেই। বৃহস্পতিবার, হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে।—নিজস্ব চিত্র।
পরিকল্পনা যে রীতিমতো সফল, তা এ দিনের মিছিল দেখার পরে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে প্রশাসন। লালবাজারের হিসেব বলছে, এ দিন আট-দশ হাজার ট্যাক্সিচালক বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, “জ্বালানি খরচ বেড়েই চলেছে। ভাড়া বৃদ্ধির কথা বললেই মন্ত্রীর রক্তচক্ষু। আবার পুলিশি হয়রানিতে ট্যাক্সিচালকদের পথে বসার উপক্রম। যেখানে-সেখানে আমাদের উপরে হাজার হাজার টাকার মামলা করে দেওয়া হচ্ছে। সব চালকই কমবেশি ভুক্তভোগী। সে কারণেই সবাই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।”
প্রশ্ন উঠেছে, ট্যাক্সিচালকদের এই পরিকল্পনার কথা ঘুণাক্ষরেও কেন টের পেলেন না পুলিশের গোয়েন্দারা? লালবাজার সূত্রে এই গোয়েন্দা ব্যর্থতা কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “ধর্মতলা থেকে কলেজ স্কোয়ার পর্যন্ত মিছিল হবে, সেটা আমরা জানতাম। কিন্তু তার জেরে যে সকাল থেকেই ট্যাক্সি চলবে না, তার খবর ছিল না।”
শুধু লালবাজারই নয়, ট্যাক্সি ধর্মঘটের আগাম কোনও ইঙ্গিত পাননি শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র নেতারাও। রাজ্যে পালাবদলের পরে অটো ইউনিয়নের দখলদারি অনেকটাই নিজেদের হাতে চলে এলেও ট্যাক্সিচালক এবং বাস-শ্রমিকদের সংগঠনে প্রভাব বাড়াতে পারেনি শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন। এ দিনের পরে আরও এক বার তা স্পষ্ট। এ সব অবশ্য মানতে চাইছেন না শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। রাজ্য সংগঠনের নেত্রী দোলা সেনের বক্তব্য, “এটা সিপিএম এবং বিজেপি-র পরিকল্পিত চক্রান্ত। গুজব ছড়িয়ে ট্যাক্সি বন্ধ করেছে। তবে আমাদের সংগঠনের কর্মীদের রাস্তায় নেমে নিত্যযাত্রীদের সাহায্য করতে বলা হয়েছে।”
দিনভর শহর জুড়ে কার্যত দাপিয়ে বেড়ানোর পরে এ সব দেখে বিজয়ীর হাসি হাসছেন আন্দোলনকারীদের নেতারা। সিটু-র এক নেতার বক্তব্য, “আমরা তো পুলিশকে মিছিলের কথা জানিয়েছিলাম। চালকেরা মিছিলে এলে যে গাড়ি চালাবে না, এটাই স্বাভাবিক। পুলিশ যদি বুঝতে না-পারে, আমরা কী করব!” আর বিজেপি-র এক নেতার বক্তব্য, “আমাদের কেউ ওই বিক্ষোভে সামিল হননি। কেউ যদি দলের পতাকা নিয়ে চলে যায়, তার দায় আমাদের নয়।”