সমৃদ্ধির বাবা মিহির মুখোপাধ্যায়। — নিজস্ব চিত্র।
পিয়ালি দ্বীপে ভয়াবহ সেই রাতের আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না তাদের।
মাঝরাতে বাবার আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সমৃদ্ধির। চোখ খুলে দেখেছিল, মুখে কাপড় বাঁধা ডাকাতরা মারছে বাবাকে। মা অসহায় ভাবে নিজেদের সম্বল তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতে। কাঁদতে কাঁদতে ডাকাতদের কাছে একটাই আর্তি জানিয়েছিল মেয়েটি—‘আমার বাবাকে তোমরা মেরো না।’ কিন্তু ছোট্ট মেয়েটির কথায় কান দেয়নি কেউ।
সমৃদ্ধির বাবা মিহির মুখোপাধ্যায় সোমবার বলেন, ‘‘ওই ঘটনার পর থেকেই মেয়ে ভীষণ আতঙ্কে রয়েছে। রাতে সাধারণত ও নিজের ঘরেই ঘুমোয়। কিন্তু রবিবার রাতে বাড়ি ফিরে ও নিজের ঘরে শোয়নি। আমার আর ওর মায়ের সঙ্গেই শুয়েছে। এমনকী বাড়ির সামনে সাইকেল নিয়ে বেরোতেও চায়নি।’’ তবে মিহিরবাবু মেয়েকে বাইরে বেরোতে সাহস জোগাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বন্ধুবান্ধব অবশ্য যখন ওকে ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা কছে, তখন বেশ সপ্রতিভ ভাবেই সে সবের উত্তর দিচ্ছে।’’
একই অবস্থা সমৃদ্ধিরই সহপাঠী সুদীক্ষার। পিয়ালির লজে সমৃদ্ধিদের পাশের ঘরটাই ছিল তাদের। ডাকাত হানা দিয়েছে বুঝতে পেরে সুদীক্ষাকে ওর মা সঙ্ঘমিত্রাদেবী বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই সে গুলির আওয়াজ পেয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে দেখে, বাবার গুলি লেগেছে। বাড়ি ফেরার পরেও আতঙ্ক কাটছে না মেয়েটির। সঙ্ঘমিত্রাদেবী জানান, মেয়ে এতটাই আতঙ্কিত যে রবিবার রাতে ঘরের আলো জ্বেলে ঘুমোতে হয়েছে তাঁদের। সোমবার হাসপাতালে যখন তাঁর বাবা সুদীপ্তবাবুর অস্ত্রোপচার হচ্ছে, তখনও তাকে একা বাড়িতে রেখে যেতে পারেননি মা। সঙ্ঘমিত্রাদেবী বলেন, ‘‘আমি এখন হাসপাতালেই ব্যস্ত। তাই মেয়েকে আপাতত ওর বন্ধুদের কাছেই রেখে আসতে হচ্ছে।’’
সমৃদ্ধি-সুদীক্ষাদের সহপাঠী ওঙ্কার বসু তার বাবা-মার সঙ্গে ওই লজের একতলার একটি ঘরে ছিল। ভয়াবহ ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেনি ওঙ্কার। কিন্তু আতঙ্ক ওর চোখেমুখেও স্পষ্ট। সোমবার মুদিয়ালির বাড়িতে বসে ওঙ্কার বলল, ‘‘শনিবার সন্ধ্যায় আমরা যখন এলাকার হাটে যাচ্ছিলাম, তখনই কয়েক জন লোক আমাদের পিছু নিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু তখন কিছু বুঝিনি। পরে মনে হয়েছে, ওই লোকগুলিই হয়তো রাতে হানা দিয়েছিল।’’
এ রকম একটি ঘটনা শিশু মস্তিষ্কে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘এটা তো একটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ধাক্কা। এর ফলে মনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস তৈরি হয়। বড়রা তা-ও যুক্তি দিয়ে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু শিশুরা তো অনেক সময়েই তা পারে না। ফলে চিন্তা ও উৎকণ্ঠা গ্রাস করে তাদের।’’ এর ফলে ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানাচ্ছেন ওই বিশেষজ্ঞ। তাঁর কথায়, ‘‘শিশুদের কাছে বাবা-মা তো আশ্রয়। তাঁদের পরাহত হতে দেখলে শিশুমনে একটা দিশাহীন ভয় তৈরি হয়।’’ একই কথা জানাচ্ছেন আর এক বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামও। ‘‘এর ফলে পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব, আতঙ্ক, দুঃস্বপ্ন, নিকটাত্মীয়কে নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ ইত্যাদি হতে পারে,’’ মন্তব্য ওই মনস্তত্ত্ববিদের।