ভয়ে। বুধবার স্কুল নিয়ে বিক্ষোভ-অবরোধে স্তব্ধ বেকবাগানে।
এক স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্কুলবাড়ির মালিকের মধ্যে আইনি বিবাদ। আর তাকে ঘিরেই বুধবার দিনের ব্যস্ত সময়ে কার্যত অচল হয়ে রইল শহরের কেন্দ্রস্থলে অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। বেকবাগানে সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের পথ অবরোধের জেরে নাকাল হলেন অফিসযাত্রী, স্কুলপড়ুয়ারা। অসুস্থ বৃদ্ধকে নিয়েই মাঝ রাস্তায় আটকে রইল অ্যাম্বুলেন্স। অবরোধকারীদের ছোড়া ইটে জখম হলেন পুলিশকর্তা। আহত হল স্কুলেরই এক পড়ুয়া। স্কুলের পোশাকেই লাঠি হাতে গাড়ির দিকে চড়াও হতেও দেখা গেল। শহরের বুকে এমন ‘বেসামাল’ অচলাবস্থা চলল টানা চার ঘণ্টা।
স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকাল থেকেই দীর্ঘদিনের আইনি জটিলতার জেরে বন্ধ হয়ে যায় বেকবাগানের সেন্ট্রাল মডেল স্কুল। এই ঘটনারই প্রতিবাদে বেলা এগারোটা থেকে বেকবাগান মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকেরা। তাঁদের অবরোধের জেরেই কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়ে বেকবাগান, এজেসি বসু রোড, রডন স্ট্রিট, সার্কাস অ্যাভিনিউ ও সংলগ্ন এলাকা। দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে থাকা এক যাত্রী বলেন, ‘‘স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্যিই পড়ুয়াদের জন্য বড় সমস্যা। কিন্তু রাস্তা আটকে তার সমাধান কি সম্ভব?’’ যানজটে নাকাল যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে তাঁদের সঙ্গে অবরোধকারীদের ঝামেলা বেঁধে যায়। অবরোধকারীরা তাঁদের মারধর করেন বলেও অভিযোগ। বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে আহত হন বেনিয়াপুকুর থানার অতিরিক্ত অফিসার ইন-চার্জ অলক সরকার-সহ আরও চার পুলিশকর্মী। ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, পুলিশের লাঠির আঘাতে জখম হয়েছেন স্কুলের এক পড়ুয়া। এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
যানজটে আটকে পড়ে অনেক আগে ছুটি হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘক্ষণ স্কুলে আটকে থাকতে হয় ওই অঞ্চলের অন্যান্য স্কুলের পড়ুয়াদের। অভিভাবকেরা খবর পেয়েও যানজটে আটকে পড়ুয়াদের কাছে যেতে পারছিলেন না।
সারাদিন ধরেই বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে ট্রাফিক সামলানোর চেষ্টা করেছে পুলিশ। ট্রাফিক পুলিশের এক কর্তা জানান, এক দিকে যেমন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের গাড়িগুলি চক্রবেড়িয়া হয়ে শরৎ বসু রোডে নিয়ে আসা হয়, অন্য দিকে শিয়ালদহ থেকে আসা গাড়িগুলিকে পার্ক স্ট্রিট হয়ে মল্লিকবাজারের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। আবার পার্ক সার্কাস কানেক্টর থেকে গাড়িগুলি কখনও পার্ক স্ট্রিট হয়ে দরগা রোডের দিকে, আবার কখনও পরমা উড়ালপুলের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ওই পুলিশকর্তা।
কিন্তু এই স্কুলে ঝামেলার কারণ কী? স্কুলের জমি সংক্রান্ত একটি মামলা সুপ্রিম কোর্টে প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে চলছিল। ২০০৫-এ রাজ্য সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, স্কুলটিকে অন্য কোনও জমি দিতে হবে। সেই থেকে প্রায় ১০ বছর কেটে গেলেও কোনও সুরাহা হয়নি জমি সংক্রান্ত এই সমস্যার। এ দিন সকালে স্কুল বন্ধ করতে পুলিশ এলেই শুরু হয়ে যায় গোলমাল। নোটিসে জানানো হয় স্কুল বন্ধের কথা। ছাত্রছাত্রীরা জানায়, এ দিন স্কুলে সপ্তম, অষ্টম, নবম এবং একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ছিল।
স্কুলের অধ্যক্ষা সুরেন্দ্র কউর সকাল থেকেই বসে ছিলেন স্কুল-চত্বরে পুলিশের ঘেরাটোপে। তিনি জানান, সরকারের গড়িমসিতেই এমন দিন দেখতে হল। দীর্ঘদিনের সমস্যা মেটাতে আমরা প্রশাসনিক সর্বস্তরে যোগাযোগ করেছিলাম। বিক্ষোভরত অভিভাবকদের কথায়, এ ভাবে কোনও জানান না দিয়ে পরীক্ষার সময়ে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া যায় না। এতদিনেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকার অনেক দিন আগেই বিকল্প জমির ব্যবস্থা করে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অভিভাবকদের না জানানোর জন্যই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। তবে রাস্তা অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা ঠিক হয়নি।’’
পরিস্থিতি সামাল দিতে নামে পুলিশের বিশাল বাহিনী। পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার পিছনে স্থানীয়দের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকেরা। এক অভিভাবক বলেন, ‘‘সকাল থেকে আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলাম। আশেপাশের এলাকা থেকে কিছু লোক এসে অবস্থা জটিল করে তোলে।’’ বিক্ষোভকারীদের দাবি, ওই এলাকাবাসীদের ইঁটের আঘাতেই আহত হয়েছে পুলিশ।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, গত মাসের ২৬ তারিখ রাজ্য অন্য একটি জমিতে উঠে যাওয়ার নির্দেশ পাঠায়। কিন্তু সেই সময়ে পরীক্ষা চলায় অন্যত্র চলে আসার মতো পরিস্থিতি ছিল না বলেই দাবি সুরেন্দ্রদেবীর। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সময় চেয়েছিলাম। সেই সময়টাই দেওয়া হয়নি।’’
পুলিশের থেকে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস পেয়ে যত ক্ষণে অবরোধ ওঠে, তত ক্ষণে চার ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। লালবাজার সূত্রে জানানো হয়, এই ঘটনায় একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। অভিভাবকদের মধ্যে ঢুকে যারা গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক।