দরিদ্র রোগীর প্রয়োজনে এবং হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নয়নে বরাদ্দ টাকার অর্ধেকের বেশি খরচ করা হচ্ছে সুপারিন্টেন্ডেন্টের গাড়ির বিল মেটাতে! বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
খোদ অধ্যক্ষ একাধিক বার স্বাস্থ্য দফতরে এই অভিযোগ জানিয়েছেন। তাতেও কোনও লাভ হয়নি। এর মধ্যে আবার গত এক বছরের আর্থিক অডিটও করা যায়নি হাসপাতালে। সংশ্লিষ্ট অডিট ফার্ম স্বাস্থ্য ভবনে গত ১০ এপ্রিল লিখিত অভিযোগ জানিয়ে বলেছে, হাসপাতালের অ্যাকাউন্টস বিভাগ থেকে বারবার তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।
আইডি হল সংক্রামক রোগ এবং ডায়রিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে রাজ্যের একমাত্র রেফারাল হাসপাতাল। গোটা রাজ্য থেকে রোগীরা এখানে ভর্তি হন। স্বাস্থ্য দফতরের নথিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে কখনও উচ্চপদস্থ কিছু স্বাস্থ্যকর্তার লিখিত নির্দেশে, কখনও কোনও লিখিত নির্দেশ ছাড়াই আইডি-র সুপারের গাড়ির খরচ হাসপাতালের ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ (আরকেএস)-র তহবিল থেকে মেটানো হয়েছে। এর জন্য অর্থ দফতরের কোনও অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এই খরচের পরিমাণটা প্রতি মাসে ১৯-২২ হাজার টাকার মতো। অথচ আরকেএস-এর টাকায় কী কী করা যাবে, তার তালিকা স্বাস্থ্য দফতর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সুপারের গাড়ির টাকা মেটানোর অনুমতিই দেওয়া নেই।
আইডি-তে দেখা গিয়েছে, হাসপাতালের আরকেএস-এ আয় যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, তখনও সুপারের গাড়ির খরচ মেটানো থামেনি। যেমন, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আইডি হাসপাতালের আরকেএস-এ জমা হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৭১ হাজার ২৫৫ টাকা। অথচ ওই ন’ মাসে আরকেএস থেকে শুধু সুপারের গাড়ির বিল মেটাতে বেরিয়ে গিয়েছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা! এই অতিরিক্ত খরচ কী ভাবে সামলানো হল? দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরের কিছু উদ্বৃত্ত টাকা আরকেএস-এ ছিল। সেখান থেকেই টাকা মেটানো হয়েছে। আইডি-র অধ্যক্ষ উচ্ছ্বল ভদ্রের কথায়, ‘‘আমার খুব অসহায় লাগে। এমন অনেক ওষুধ বা চিকিৎসা সামগ্রী গরিব রোগীদের দরকার পড়ছে যা ক্যাটলগ আইটেম নয় বলে হাসপাতাল থেকে দেওয়া যায় না। আমরা আরকেএ-এর টাকা থেকে কিনে রোগীদের দিই। তার মধ্যে অনেক কিছু টাকার টানাটানিতে কিনতে পারছি না। অথচ সুপারের গাড়ির টাকা আরকেএস থেকে মিটিয়ে যেতে হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকা।’’
হাসপাতালের নথি থেকে দেখা গিয়েছে, ২০১৪ সালের অগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রোগীদের জন্য ৯২ হাজার ৩৫৯ টাকার ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনা হয়েছিল। কিন্তু সেই বিল এখনও পর্যন্ত মেটানো হয়নি। সরবরাহকারীরা জানিয়ে দিয়েছেন, টাকা না পাওয়া পর্যন্ত আইডি-কে আর কোনও জিনিস তাঁরা ধারে দেবেন না। এই বিলগুলি আরকেএস-এর টাকা থেকেই মেটানোর কথা। বিল মোটানো বাকি থাকলেও ওই পাঁচ মাসে আরকেএস তহবিল থেকে সুপারের গাড়ির জন্য ১ লক্ষ টাকার বেশি মেটানো হয়েছে।
২০০২ সালের ৩০ এপ্রিল রাজ্য অর্থ দফতর থেকে একটি নির্দেশিকা বার করা হয়। তাতে বলা হয়েছিল, প্রিন্সিপাল সচিব, সচিব, বিশেষ সচিবরা গাড়ি পাবেন। এবং প্রতি তিন জন যুগ্ম সচিব পিছু একটি করে পুল-কার থাকবে। এই সব গাড়ি ব্যবহারের আগে অর্থ দফতরের অনুমোদন নিতে হবে। আইডি-তে সেই অনুমতি নেওয়া হয়নি। তার উপরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট যুগ্ম সচিব স্তরের অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পুল-কারের বদলে আলাদা গাড়ি দেওয়া হয়েছে।
কেন তিনি আলাদা গাড়ি পাবেন এবং কেন সেই গাড়ির খরচ হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির টাকা থেকে মেটানো হবে? এ ব্যাপারে সুপার শ্যামাপ্রসাদ মিত্রকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর উত্তর, ‘‘আমার গাড়ি দরকার ছিল। স্বাস্থ্য ভবনে আবেদন করেছিলাম। ওরা অনুমোদন করেছে। আমি তো সেই গাড়ির টাকা আরকেএস থেকে দিতে বলিনি। স্বাস্থ্যকর্তারা সেই নির্দেশ দিলে আমার কী দোষ? ওঁদের জিজ্ঞাসা করুন।’’ তিনি আরও জানান, ওই গাড়িতে তিনি প্রতিদিন বাঘা যতীনে নিজের বাড়ি থেকে বেলেঘাটায় যাতায়াত করেন। এবং যেখানে-যেখানে বৈঠকে যেতে হয় বা কাজের প্রয়োজনে যেতে হয়, সেখানে যান।
হাসপাতালের নথিতে দেখা গিয়েছে, ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ওই গাড়ি ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য দফতর আলাদা করে ২ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা অনুমোদন করেছিল। কিন্তু ওই সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কোনও নির্দেশ ছাড়াই সুপার ওই গাড়ি চড়েন। তার ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার ৮৭৬ টাকার বিল মেটানো হয় আরকেএস থেকে। ওই সময়ে রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সমিতির এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন প্রবীর লাহিড়ী। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘বিষয়টি একেবারেই বৈধ হয়নি। কিন্তু করতে হয়েছিল। নির্দেশ ছিল। অথচ স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ম অনুযায়ী আরকেএস-এর টাকা এর জন্য খরচ করা যায় না।’’
কিন্তু রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সমিতির বর্তমান এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর সঙ্ঘমিত্রা ঘোষও গত ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে আবার ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ওই গাড়ির খরচ আইডি-র আরকেএস থেকে মেটানোর নির্দেশ দিয়ে দেন। ফের গত পয়লা এপ্রিল লেখা আর একটি চিঠিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সমিতির আর্থিক উপদেষ্টা সুদেবরঞ্জন ভৌমিক ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাড়ির খরচ আরকেএস থেকে মেটানোর অনুমতি দেন।
কিন্তু যে টাকা রোগী ও হাসপাতালের জন্য খরচ হওয়ার কথা, তা নিয়ম ভেঙে কী করে তাঁরা সুপারের গাড়ির জন্য খরচের অনুমতি দিতে পারেন? এ ব্যাপারে সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের মন্তব্য, ‘‘আমাদের প্রফেশনাল এথিক্স হল আমরা সাংবাদিকদের এই সব প্রশ্নের উত্তর দিই না।’’ আর সমিতির আর্থিক উপদেষ্টা সুদেবরঞ্জন ভৌমিক ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করব না’’ বলে পাশ কাটিয়ে যান।