রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে দুই যুবক। উপস্থিত স্থানীয় থানার পুলিশকর্তা। পাশেই দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স। চলছে ঝগড়া!
এক যুবক নাকি ‘স্পট ডেড’, তাই অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা যাবে না। এ কথা জানিয়ে পুলিশের সঙ্গে গলা চড়িয়ে তর্ক করে চলেছেন অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা। পার হয়ে যাচ্ছে অমূল্য সময়। শেষ পর্যন্ত অন্য একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এক জনকে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন তিনি। অন্য জনকে স্থানীয়দের চাপে পড়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওই প্রথম অ্যাম্বুল্যান্সই। তবে বাঁচানো যায়নি তাঁকে। রবিবার দুপুরে অমানবিকতার এই চরম দৃষ্টান্তের সাক্ষী রইল হাওড়ার ছ’নম্বর জাতীয় সড়কের রাজচন্দ্রপুর টোল প্লাজা সংলগ্ন এলাকা।
মাস কয়েক আগেই ওড়িশার কালাহাণ্ডির বাসিন্দা দানা মাঝি সংবাদের শীর্ষে এসেছিলেন এমনই অমানবিকতার শিকার হয়ে। বাড়ি থেকে ৬০ কিমি দূরের সরকারি হাসপাতালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে বাড়িতে দেহ আনার জন্য জোটেনি গাড়ি। দেহ কাঁধে নিয়েই হাঁটতে শুরু করেন দানা মাঝি। হেঁটেও ফেলেন দশ কিমি। পরে সংবাদমাধ্যমের দ্বারা বিষয়টি জানাজনি হলে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সমস্ত মহলে তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে। রবিবার হাওড়ার জাতীয় সড়কের ঘটনায় অবশ্য গাড়ির অভাব ছিল না। অভাব ছিল না তৎপরতারও। তা সত্ত্বেও, এড়ানো গেল না মৃত্যু। কারণ, স্রেফ অমানবিকতা।
পুলিশ জানায়, বিশরপাড়ার বাসিন্দা, ৩৫ বছরের শচীন হালদার একটি স্কুটারে করে রবিবার সকালে বাড়ি থেকে ধূলাগড় যাচ্ছিলেন ছ’নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। পেশায় ইন্টেরিয়র ডেকরেটর শচীনের সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী অতনু ঘোষ। দুপুর বারোটা নাগাদ বালির মাইতিপাড়া ব্রিজের কাছে একটি লরি পিছন থেকে তাঁদের ধাক্কা মেরে পালায়। বাঁ দিকে ছিটকে পড়েন পিছনে বসে থাকা অতনু। চালক শচীন পড়েন ডান দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লরির চাকা চলে যায় শচীনের উপর দিয়ে। ঘটনার পরে শচীনের জ্ঞান ছিল না, অতনু ওঠার চেষ্টা করছিলেন কোনও রকমে।
খবর পেয়ে মিনিট আটেকের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান নিশ্চিন্দা থানার ওসি। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স চেয়ে খবর যায় নিকটবর্তী রাজচন্দ্রপুর টোলপ্লাজায়। ন্যাশনাল হাইওয়ের নির্দেশিকা মেনে, দেশের প্রতিটি জাতীয় সড়কের সব টোল প্লাজাতেই মজুত থাকে অ্যাম্বুল্যান্স। এ দিনের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে অ্যাম্বুল্যান্স চলেও আসে কয়েক মিনিটে। তাতে ছিলেন চালক এবং এক কর্মী।
পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ওই দুই অ্যাম্বুল্যান্স কর্মী দাবি করেন, যেহেতু এক জন মারা গিয়েছেন, তাই কাউকেই অ্যাম্বুল্যান্সে তুলতে পারবেন না তাঁরা। বিস্মিত পুলিশকর্তা জানান, মারা গিয়েছেন কি না, তা বোঝা সম্ভব নয়। অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীদের। তাতেও কিছু হয়নি। ওসি-র সঙ্গে বাক্বিতণ্ডায় জড়িয়ে যান অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা। ওসি সঞ্জীব সরকার বারবার বলেন, মানুষটা মৃত না জীবিত সেটা একমাত্র চিকিৎসকই নিশ্চিত করতে পারেন। গলা চড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা বলেন, ‘‘আমরা কিছুতেই নিতে পারব না। নির্দেশ আছে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত মানুষকে অ্যাম্বুল্যান্সে না তোলার।’’
মিনিট পনেরো চলে এই তর্ক-বিতর্ক। তত ক্ষণে ওসি-র তৎপরতায় খবর গিয়েছে হাওড়া শহর পুলিশের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে। দুর্ঘটনাস্থলে জড়ো হয়েছেন স্থানীয়রা। ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত ওসি সঞ্জীববাবু সিদ্ধান্ত নেন, নিজের গাড়িতেই ওই দু’জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। ইতিমধ্যে এসে পৌঁছয় ট্রমা কেয়ার সেন্টারের অ্যাম্বুল্যান্স। তাতে করে গুরুতর আহত অতনু ঘোষকে হাওড়ার জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাতে এক জনের বেশি লোককে নেওয়া সম্ভব না-হওয়ায় ঠিক হয়, ওই অ্যাম্বুল্যান্সই ফের এসে নিয়ে যাবে শচীনকে। এই সময়ে খেপে ওঠেন জড়ো হওয়া স্থানীয় মানুষ। বেগতিক দেখে তখন শচীনকে তুলতে রাজি হন টোল প্লাজার অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা। তত ক্ষণে পেরিয়েছে আধ ঘণ্টা। বেলুড় স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে শচীন হালদারকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয়রা। পুলিশ এত বার বললেও অত ক্ষণ ধরে তর্ক করে গেলেন অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীরা! ওই সময়টা নষ্ট না হলে হয়তো শচীনবাবুকে বাঁচানো যেত, আক্ষেপ বিক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের। একই আক্ষেপ করছেন শচীনবাবুর পরিবারের সদস্যরা। শচীনবাবুর মাসতুতো দাদা সমর ভৌমিক বলেন, ‘‘ঘটনাস্থলে পৌঁছে শুনলাম প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল অ্যাম্বুল্যান্স। সময়ে নিয়ে গেলে প্রাণটা হয়তো বেঁচে যেতে পারত।’’
কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীদের এমন অমানবিক আচরণের কারণ কী? নিকটবর্তী রাজচন্দ্রপুর টোল প্লাজার দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থা ‘নিবেদিতা সেতু টোলওয়ে কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’-এর কর্তা প্রবীণ বসন্ত জানান, ঘটনাটি শুনেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পুলিশের কাজ, অ্যাম্বুল্যান্সের নয়। আমাদের কর্মীরা সেটাই বলতে চেয়েছিলেন।’’ তাঁর দাবি, পরে এক জনকে নিয়ে যাওয়া হয় ওই অ্যাম্বুল্যান্সেই।
ঘটনার কথা শুনে রীতিমতো বিস্মিত ‘ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া’-র কলকাতা শাখার প্রজেক্ট ডিরেক্টর এস কে কুশওয়াহা। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনাটি অমানবিক। কেন এমন ঘটেছে, তা জানতে ওই টোল সংস্থার কাছে জবাব চাইব আমরা। প্রয়োজনে অ্যাম্বুল্যান্স কর্মীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করা হবে।’’ তিনি জানান, যে কোনও জাতীয় সড়কেই চট করে গণ-পরিবহণের সুবিধা পাওয়া যায় না। তাই, দুর্ঘটনা বা এ ধরনের আপৎকালীন অবস্থার কথা মাথায় রেখে প্রতিটি টোল প্লাজায় অ্যাম্বুল্যান্স, ব্রেক ডাউন ভ্যান, দমকলের একটি ইঞ্জিন ইত্যাদি পরিষেবা মজুত রাখা থাকে। সেই জরুরি পরিষেবা পেতে গিয়ে যদি এমন অভিজ্ঞতা হলে তা দুর্ভাগ্যজনক। ঘটনাটি শুনে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘মৃত মানুষকে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা যাবে না’, এ রকম কোনও নির্দেশ তাঁদের তরফে অন্তত নেই। কারণ মৃত্যু হয়েছে কি হয়নি, তা নিশ্চিত করতে পারেন একমাত্র চিকিৎসকই।