জোড়াসাঁকোয় কবিতা পাঠে ইরাক যুদ্ধের সেনা

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩৪
Share:

ব্রায়ান টার্নার

রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে বসে মৃত্যু, শূন্যতা, জীবনের অপচয়ের কবিতা কি আদৌ মানায়? ভাবছিলেন কবি!

Advertisement

অচিন শহর কলকাতায় নামার পরপরই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হাজির জেটল্যাগধ্বস্ত আলুথালু, কিন্তু মিশুকে হৃষ্টপুষ্ট অবয়ব। ক্যালিফর্নিয়া থেকে আগত পঞ্চাশোত্তীর্ণ ব্রায়ান টার্নার। বসনিয়া থেকে ইরাকের মোসুল, বাগদাদে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই কবি হিসেবে যাঁকে গড়ে-পিটে নিয়েছে। কলকাতায় নেমেই আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের মঞ্চে ওঠার তাড়া। শনিবার সকালে সে-সব মিটলে অস্ফুটে ব্রায়ান বললেন, ‘‘লোকে আমায় ‘ওয়ার পোয়েট’ (যুদ্ধের কবি) তকমা দিলেও আসলে প্রেমের, ক্ষয়ের আর নতুন করে পাওয়ার কথাই লিখি আমি।’’

ইংরেজি সাহিত্যের ‘ওয়ার পোয়েট’ উইলফ্রেড আওয়েন, সিগফ্রিড সাসুনরা বহু পঠিত বাঙালির মধ্যে। কিন্তু সাবেক বিশ্বযুদ্ধের কবিতার শূন্য জনপদ, শোকস্তব্ধ ঘরবাড়ির পাশে হাড়-হিম শূন্যতা, ধ্বংসের ছবি উঠে আসছে ব্রায়ানদের একুশ শতকীয় অভিজ্ঞতার বীভৎসতায়। নিজের লেখার সঙ্গে আর এক যুদ্ধ-বিরোধী ইজ়রায়েলি কবি ইয়েহুদা আমিচাইয়ের কবিতাও পড়লেন ব্রায়ান। মারণ বোমার মাপজোক আর হিংস্র বুলেটের অমোঘ পরিণতির কবিতা! মসুলে এক সময়ে ট্যাঙ্কে টহলদারি, আর বাড়ি-বাড়ি লাথি মেরে দরজা খুলে ঢুকে তল্লাশির কাজ করতে হত তাঁকে। কবিতারা তাঁর কাছে আসত সেই যুদ্ধধ্বস্ত দিনগুলোর রাতেই।

Advertisement

‘‘কবি হিসেবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, ঠিক সময়ে ঠিক প্রশ্নটা মেলে ধরাই আমার কাজ।’’— বললেন বহু প্রশংসিত, পুরস্কৃত ‘হিয়ার, বুলেট’ কাব্যগ্রন্থের লেখক। আদতে কয়েক প্রজন্ম ধরে আমেরিকায় যোদ্ধাদের বংশের ছেলে ব্রায়ান। দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধে গিয়েছেন দাদু-কাকারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক হামলার জেরে এক দাদুর মৃত্যু। ব্রায়ানের সৎবাবাও ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’র সময়ে ‘প্যাসিফিক ইউনিটের’ গুপ্তচর বিমানে তথ্য সংগ্রহ করতেন।

এত কিছু দেখেও কী ভেবে সেনায় যোগ দিলেন?

‘‘ব্যাপারটা উদ্ভট! যুদ্ধ তখন আমার সামনে অজানা পৃথিবীর হাতছানি হয়েই এসেছিল। আমেরিকাতেও অনেকে নতুন দেশ দেখা, দামি গাড়ি কেনা বা একঘেয়েমি কাটাতে যুদ্ধে যোগ দেয়। যুদ্ধ যে কত একঘেয়ে, তা যদি বুঝতাম!’’— বিষণ্ণ হেসে জবাব দেন ব্রায়ান। তবে যুদ্ধ বলতে এখন সন্ত্রস্ত শিশু বা অসহায় মানুষের কথাই বেশি মনে পড়ে তাঁর। ‘‘আমাকেও ইরাকে কত লোককে জেরা করতে হয়েছে। ভুল লোককে শাসিয়েছি। মনে হয়, কাজগুলো খুনের থেকে কিছু কম খারাপ নয়। তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হয়।’’— বলে ওঠেন কবি।

কলকাতা বলতে কফি হাউস, বটানিক্যাল গার্ডেন থেকে দুর্গাপুরের কাছের কুষ্ঠ কলোনি একাকার ব্রায়ানের চেতনায়। ‘‘আমি খোলা মনে এই নতুন দেশটাকে বুঝছি।’’— পর্তুগিজ কবি সারা এফ কস্টা, এ দেশের অরুন্ধতী সুব্রহ্মণ্যম, যশোধরা রায়চৌধুরী, সনেট মণ্ডলদের সঙ্গে কথার ফাঁকে বলছিলেন কবি। ক্যানসারের কাছে স্ত্রীকে হারিয়েছেন দু’বছর আগে। বললেন, ‘‘নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবি, ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার!’’ ব্রায়ান মনে করেন, যুদ্ধ-রাজনীতি মানুষের মাঝে পাঁচিল তোলে। কবির চিত্রকল্প সবাইকে মেলায়। পেয়ে হারানোর কষ্টটা বুঝলেই মানুষ ফের জীবনকে আঁকড়ে ধরে।

ব্রায়ানকে বলা হয়নি, হারিয়ে নতুন করে পাওয়ার কথা বলে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন