লড়াই: আর অনন্তকৃষ্ণনের (বাঁ দিকে) সঙ্গে ‘আলাপচারিতা’য় সস্ত্রীক অরুণকান্তি ঘোষ। নিজস্ব চিত্র
‘আমি ভাল আছি’!
স্বরযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের ছ’মাস বাদে গত মার্চে ডাক্তারবাবুর তাড়নায় এটুকুই বলতে পেরেছিলেন পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার অরুণকান্তি ঘোষ। আর এখন রীতিমতো জমিয়ে বাজারহাট করছেন তিনি। স্ত্রী মনীষা দেখছেন, ঝগড়া করার পুরনো ‘ফর্ম’ও ফিরে এসেছে কর্তার!
গলায় ফুটো করে বসানো একটি ভাল্ভের সাহায্যে ‘ট্র্যাকিও-ইসোফেগাল প্রস্থেসিস’ পদ্ধতিতে কথা বলেন অরুণবাবু। সেই যন্ত্রটি কয়েক মাস অন্তর বদলাতে হয়। এক-এক বারে ৪৫ হাজার টাকার ধাক্কা। এটাই চিন্তা অরুণবাবুর।
যন্ত্র ছাড়া ইসোফেগাস বা খাদ্যনালীতে হাওয়া ভরে ঢেঁকুর তুলে কথা বলার (ইসোফেগাল ভয়েস) ব্যাপারে অরুণবাবুকে ভরসা দিচ্ছেন জনৈক খর্বকায় প্রবীণ। “আমি ঠিক শেখাব!
আপনিও পারবেন ‘ডেঁকুর’ (ঢেঁকুর) তুলে কথা বলতে। ইসোফেগাল ভয়েস ইজ দ্য বেস্ট।’’ যিনি বলছেন, তাঁর নাম আর অনন্তকৃষ্ণন। স্বরযন্ত্র আর খাদ্যনালী (ইসোফেগাস), দুটোই অস্ত্রোপচারে খুইয়েছেন তিনি। এখন কথা বলেন গুপি গাইন বাঘা বাইনের ভূতের রাজার কণ্ঠে। তবে থেমে থেমে, গলার ফুটোয় টর্চের মতো একটা যন্ত্র ধরে ইলেকট্রো ল্যারিঙ্গস স্বরে।
দু’দশক আগে ‘কথা বেচে’ খাওয়াটাই তাঁর পেশা ছিল বলা যায়! এখনও সেটাই পেশা। তবে বিপণন বা মার্কেটিং পেশাদার থেকে তিনি এখন কথা বলা শেখানোর শিক্ষক। নিজের লড়াই লড়তে লড়তেই আরও কত জন ‘ভাষাহারা’র ভরসা হয়ে উঠেছেন মধ্য ষাটের ‘তরুণ’। দেশের সর্বত্র ক্যানসার বিশারদ, স্পিচ থেরাপিস্টরা এক ডাকে তাঁকে চেনেন। কলকাতা, চেন্নাই মিলিয়ে শ’দেড়েক ক্যানসার-উত্তীর্ণের মুখে ফের কথা ফুটিয়েছেন অনন্তকৃষ্ণন।
চাকরিজীবনের গোড়া থেকে কলকাতাবাসী এই তামিলভাষীকে অনায়াসেই বাঙালি বলা যায়। মাতৃভাষা ছাড়াও অনর্গল বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তেলুগু বলতে পারেন। কাজ চালানোর দক্ষতা রয়েছে আরও চার-পাঁচটি ভাষায়। পুরনো ভিডিয়ো সাক্ষী, ইসোফেগাল স্বরে ক্যানসার-সচেতনতায় অনন্তকৃষ্ণনের লম্বা বক্তৃতা শুনলে অবাক লাগে, কত দূর অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি।
স্পিচ থেরাপিস্ট ও প্যাথলজিস্ট দীপান্বিতা রায় বলছিলেন, ‘‘ইসোফেগাল স্বরে এক নিঃশ্বাসে দু’-একটার বেশি শব্দ বলা কঠিন। তা ছাড়া, পেটে হাওয়া ভরে কথা বলার জন্য আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। তিন-চার মাস সময় লাগে। সাফল্যের হারও ১০-১৫ শতাংশ। তবে রপ্ত হলে ওটাই সেরা পদ্ধতি।’’
দেড় দশক আগে স্বরযন্ত্র খোয়ানোর পরে দু’মাস টানা দিনে ১২ ঘণ্টা করে অনুশীলন করেন অনন্তকৃষ্ণন। গত বছরের শেষ দিকে সবেধন খাদ্যনালীটি খুইয়েছেন ক্যানসারের দ্বিতীয় হামলায়। অস্ত্রোপচারের পরে তাঁর পাকস্থলীটি এখন ফুসফুসের মাঝখান দিয়ে তুলে জিভের গোড়ায় বসিয়ে দিয়েছেন ডাক্তারেরা। নাছোড় প্রৌঢ় তবু আত্মবিশ্বাসী। “আর ঠিক দুটো মাস লাগবে! যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই পাকস্থলীতে হাওয়া টেনেও আমি কথা বলব।”
একেবারে গোড়ায় উজান ঠেলা এই যোদ্ধাকে কথা বলার তালিম দিয়েছিলেন আর এক অপরাজেয় প্রবীণ বিভূতিভূষণ চক্রবর্তী। সাম্প্রতিক বাংলা ছবি ‘কণ্ঠ’র প্রেরণা এই বিভূতিবাবু। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়দের সঙ্গে একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে তাঁর আলাপ। কর্কট রোগে ভাষাহারাদের নিয়ে সিনেমা-ভাবনার সেই সলতে পাকানো। ১৯৭৪-এ ক্যানসারে বিভূতিবাবুর স্বরযন্ত্রটিও ডাক্তারেরা কেটে বাদ দেন। এর পরে আমৃত্যু ইসোফেগাল স্বরে আরও অনেককে কথা বলতে শিখিয়েছেন তিনি। খাদ্যনালীর স্বরে কথা বলা শেখানো নিয়ে বাংলা বই লেখা ছাড়াও ল্যারিঞ্জেক্টমি ক্লাবও গড়েছিলেন বিভূতিবাবু। অনন্তকৃষ্ণন সেই লড়াকু নিঃস্বার্থপরতারই উত্তরাধিকারী।
এ বার আরও কয়েক জন ক্যানসার-উত্তীর্ণ ও তাঁদের পরিজনেদের নিয়ে ক্লাব গড়ার উদ্যোগেও শরিক তিনি। দশটি পরিবার ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পরে গলা, মুখের চারপাশের অসাড়তা কাটাতে কী কী ব্যায়াম করতে হবে, মুখস্থ অনন্তকৃষ্ণনের। তবে নিছক রোগভোগের মোকাবিলাটাই ক্লাবের মুখ্য উদ্দেশ্য হোক, চান না তিনি।
এসএসকেএম হাসপাতালের ভিজিটিং কনসালট্যান্ট, হেড-নেক ক্যানসারের শল্য চিকিৎসক সৌরভ দত্ত ও হর্ষ ধরের মতো কয়েক জন ডাক্তারবাবুও এই লড়াকুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা হাওড়ার একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। হাসপাতালের তরফে অনন্তকৃষ্ণনদের পরিকাঠামোগত সাহায্য করা হচ্ছে। সৌরভবাবুর কথায়, “স্বরযন্ত্রবিহীন মানুষদেরও হাল ছাড়ার কিছু নেই। আমরা চাই, ক্লাবে ওঁরা গান, আবৃত্তি, নাটকের আনন্দও খুঁজে নিন। অবসাদ কাটিয়ে বাঁচার এই রসদটাই সুস্থ থাকার হাতিয়ার হতে পারে।’’