মুছে গেল হাঙ্গেরিয়ান সাহেবের স্মৃতি

কলকাতার মাংস রসিকদের একটা সোনালি অধ্যায় সঙ্গে নিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের সেই খুপরি দোকানঘর এ বার কার্যত উবে গেল।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৭
Share:

অতীত: নিউ মার্কেটে বন্ধ সেই দোকান। নিজস্ব চিত্র

বন্ধ দোকানঘর খুলে গণেশের তাকটা দেখলে এখন বুক খাঁ খাঁ করে জয় ঘোষের। তাঁর পুজো সেরে এই সে দিনও রাশি রাশি হ্যাম-সসেজ-অক্সটাঙের তাল কাটাকুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তিনি।

Advertisement

কলকাতার মাংস রসিকদের একটা সোনালি অধ্যায় সঙ্গে নিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের সেই খুপরি দোকানঘর এ বার কার্যত উবে গেল। চলতি সপ্তাহের সোমবারই শেষ কেনাবেচা হয়ে গিয়েছে। তার বদলে সেখানে শুরু হবে কোনও কাপড়ের দোকান। সদ্য সমাপ্ত বর্ষবরণ-ক্রিসমাসেও শহরের অভিজাত ক্লাবকে ২০০ কিলোর টার্কি বা পর্ক লয়েন, স্মোক্‌ড হ্যাম সরবরাহ করেছে কালম্যান। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের শীতের কলকাতার সম্পদ সল্টমিটও দেদার বিকিয়েছে। শীতের শহরে ভিড় করা প্রবাসী বা রাজস্থান-ঝাড়খণ্ডের বাঁধা খদ্দেররা কালম্যানে হানা দিয়ে তাদের তুরুপের তাস ঝাল ঝাল বিফ কলার বা টকটকে লাল হাঙ্গেরিয়ান সসেজ কিনে নিয়ে গিয়েছেন। তবু ব্যস্ততার আড়ালে কালম্যানের শোকগাথা লেখার মঞ্চও প্রস্তুত ছিল।

মাংস স্মোক করা বা সসেজ-হ্যাম তৈরির শিল্পী-মিস্ত্রি, অশোক সোনকর, দিলীপ সিংহ, আব্দুল রাজুদের যুগ শেষ হয়েছে। মিনতি চক্রবর্তী, সুদীপ ধর বা নিখিল লোধরাও এখন প্রৌঢ়। দোকানের রোজকার যুদ্ধের সেনাপতি জয় বলছিলেন, ‘‘নতুন কারিগর পেলাম না। বাঁধা খদ্দেরদের নিরাশ করতে চাইনি বলেই ডিসেম্বরটা কষ্ট করে টানলাম।’’ ওই তল্লাটে পুরনো বই বা গানবাজনার সরঞ্জামের দোকান জুড়ে এই ২০১৯-এও উঁকি দেয় পুরনো কলকাতা। তার অনেকটাই মুছে যাচ্ছে। নিউ মার্কেটে ডি’গামা-র কেক, পার্ক স্ট্রিটের স্কাইরুম বা ব্লু ফক্স এখনও কোনও কোনও মাঝবয়সী বা প্রবীণের স্মৃতিতে টিকে। এ বার সেই দলে কালম্যানও নাম লেখাল।

Advertisement

কালম্যানের দীর্ঘদিনের অনুরাগী অভিনেতা গায়ক অঞ্জন দত্তের পরিবার। অঞ্জন বলছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু অহেতুক নস্ট্যালজিয়ায় বিশ্বাসী নই। দোকানপাট, রাস্তা পাল্টানোটা যে কোনও শহরের ধর্ম। তবে কিছু দোকান, বাড়ি বা পাড়ার সঙ্গে শহরের ইতিহাস-সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে।’’ ঠান্ডা মাংসের নামী-দামি সংস্থা শহরের বাজারে ঢুকছে। কিন্তু বিফ-পর্ক-ডাক-চিকেন থেকে শুরু করে এত ধরনের মাংসের পদ কালম্যানের ছাদের তলায় মিলত, যা আর কোথাও এক সঙ্গে মেলে না। সেখানে গেলেই শহরের প্রবাসী অতিথি থেকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চিনে, বাঙালি খৃষ্টান গোষ্ঠীর কারও সঙ্গে অবধারিত দেখা হত, তথাকথিত মূল স্রোতের কলকাতার। অন্য শপিংমল ও বাজারে ভিড়ের মধ্যে এই বৈচিত্রের মজা সব সময়ে চোখে পড়ে না। কলকাতার কিছু শপিংমল-মাল্টিপ্লেক্সে ইদানীং আমিষের প্রবেশ নিষেধ। বেশিরভাগ জায়গার পণ্য বা খাবার-দাবারও এক ধাঁচের। অঞ্জন বলছিলেন, ‘‘কালম্যানের মাংসের বৈচিত্র একটা ইনক্লুসিভ কলকাতার গল্পও বলে। কাউকে নিয়েই তার ছুতমার্গ নেই।’’

১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হাঙ্গেরিয়ান সাহেব কালম্যান গোহারিই ছিলেন এই দোকানের প্রাণপুরুষ। তিনি কলকাতা ছাড়ার পরে ঠান্ডা মাংসের কারবার টানছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী বিষ্ণুপদ ধরের পরিবার। প্রয়াত বিষ্ণুপদবাবুর মেয়ে আগমনি বললেন, ‘‘হয়তো পরের মাসেই এখানে কাপড়ের দোকান শুরু হবে।’’ মাংস স্মোক করার আলমারি, মশলাজল-মাখা কিউরড মাংস রাখার কুঠুরি, হ্যাম-সসেজ তৈরির সরঞ্জাম তখন পরপর বেরোচ্ছে দোকান থেকে। পুরনো যন্ত্রের গায়ে হারানো

সময়ের দিকচিহ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন