‘রোগী’ প্রাণ পায় এই হাসপাতালে

এক বার বিদেশ থেকে বেশ কয়েক জো়ড়া জুতো কিনে এনে মহা সমস্যায় পড়েন এক তরুণী। কোনওটাই পায়ে হচ্ছে না। তিনিও ফল পেয়েছিলেন জুতোর হাসপাতালে গিয়ে।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৫৪
Share:

শুশ্রূষা: চলছে জুতো সারাই। —নিজস্ব চিত্র।

ইমার্জেন্সিতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। প্রতি কেবিনে সার সার রোগী। অপারেশন থিয়েটারে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন চিকিৎসক! আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রোগীকে বাড়ি থেকে আনা এবং চিকিৎসা শেষে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রয়েছে জরুরি পরিষেবাও।

Advertisement

শহরের অন্যান্য হাসপাতালের মতো এই হাসপাতালেও রোগীর অভাব নেই। তবে রোগীরা কেউ মানুষ নন। প্রাণীও নয়।—জুতো। চিকিৎসকেরা প্রত্যেকেই ‘জুতোর ডাক্তার’। এই নিয়েই উত্তর কলকাতায় দিব্যি চলছে ‘জুতোর হাসপাতাল’। আদতে জুতো সারাইয়ের কারখানা।

কারখানার মালিক তেজপ্রতাপ সিংহ চড্ডার দাবি, মানুষ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন ভুল জুতো পরার জন্য। এতে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাঁর বাবারও ভুল জুতো পরার জন্য মৃত্যু হয়েছিল বলে দাবি তেজপ্রতাপের। এর পরেই জুতো সারাইয়ের কারখানা তৈরি করবেন বলে ঠিক করেন তেজপ্রতাপ। নাম দেন ‘জুতোর হাসপাতাল’। তবে ওই কারখানাকে হাসপাতাল বলে ডাকতে অভ্যস্ত তেজপ্রতাপ। সেখানে কাজ করা চন্দন সাহা, শুভম দে’রা প্রত্যেকেই ‘জুতোর ডাক্তার’।

Advertisement

বছর দুই ধরে চলছে তিন কামরার এই হাসপাতাল। ‘চিকিৎসক’ এবং বাড়ি বাড়ি পৌঁছে পরিষেবা দেওয়ার কর্মী রয়েছেন ২০ জন। তেজপ্রতাপের কথায়, ‘‘ফোন করে জানালে রোগী আনতে কলকাতা, হাওড়া এবং হুগলির ঠিকানায় পৌঁছে যান কর্মীরা। দেওয়া-নেওয়ার সেই পরিষেবা বিনামূল্যে। এই পরিষেবা গোটা রাজ্যের পাশাপাশি উত্তর ভারত ও উত্তর পূর্ব ভারতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য কথা চলছে কয়েকটি ক্যুরিয়ার সংস্থার সঙ্গে।’’

তেজপ্রতাপ বলেন, ‘‘বাবার ব্লাড-সুগার ছিল। তার মধ্যেই পায়ে আঘাত পান। সেই সময় বাবা এমন এক জুতো পরতেন যা থেকে পায়ে পচন ধরেছিল। পরে বাবা মারা যান। তখনই মনে হয়েছিল হাসপাতাল করব। তাই জুতোর হাসপাতাল খুলেছি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আসলে মানুষের পায়ের ফ্যাশন আছে, পায়ের গুরুত্ব নেই।’’ কিন্তু হাসপাতাল নাম হল কেন? তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে মানুষের ‘সার্জারি’ হয়। ওষুধ দিয়ে সুস্থ করা হয়। যত দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা হয়, তত হাসপাতালের সুনাম বাড়ে। আমরাও জুতোর দুরারোগ্য সমস্যা সারাচ্ছি। তা হলে হাসপাতাল বলব না কেন?’’

হাসপাতাল করার ফলে জুতো ঘিরে মানুষের নানান আবেগ তাঁর চোখে ধরা পড়েছে বলে জানান তেজপ্রতাপ। এক বার এক বৃদ্ধা তাঁর কাছে গিয়ে জানান, নাতনি বিদেশ থেকে জুতো পাঠিয়েছে। কিন্তু, সেই জুতোয় ‘হিল’ রয়েছে। বৃদ্ধা ‘হিল’ পরতে অনভ্যস্ত। সমস্যার সমাধান করে দেয় তেজপ্রতাপের হাসপাতাল। বললেন, ‘‘রোগ সারিয়ে দিয়েছি। হিল কেটে জুতো ফেরত দেওয়ার পরে সে কী আনন্দ বৃদ্ধার।’’

এক বার বিদেশ থেকে বেশ কয়েক জো়ড়া জুতো কিনে এনে মহা সমস্যায় পড়েন এক তরুণী। কোনওটাই পায়ে হচ্ছে না। তিনিও ফল পেয়েছিলেন জুতোর হাসপাতালে গিয়ে।

শহরের বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় বসে জুতো সারানোর কাজ করেন যাঁরা, এই ‘জুতোর হাসপাতাল’-এর কথা শুনে তাঁরাও তাজ্জব! উল্টোডাঙার ফুটপাথে জুতো সারানোর কাজ করা শম্ভু সরকার বললেন, ‘‘এ ভাবে তো ভাবিইনি কখনও।’’ হাতিবাগানের কনক সামন্ত অফিস যাত্রীর বুট পালিশ করতে করতে বললেন, ‘‘এত বছর জুতো সারাইয়ের কাজ করছি, নিজেদের কাজ নিয়ে আগে এত আনন্দ হয়নি। জুতোর হাসপাতাল দেখার ইচ্ছা রইল।’’ জুতোয় পেরেক মারতে মারতে হাসছিলেন কালীঘাটের লালু সিংহ। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমরা তো হাসপাতালে কাজ করি না। তবে সব জানার পরে এ বার নিজেদের ডাক্তারবাবু বলতে পারব! আমাদের চেম্বার হল ফুটপাথ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন