সেন্ট জেভিয়ার্স

হস্টেলের ছাদ থেকে পড়ে রহস্যমৃত্যু ছাত্রের

হস্টেলের ‘ডিনার আওয়ার’ তখনও শেষ হয়নি। ছাত্রদের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে নৈশভোজ সারছিলেন ফাদাররা। শুক্রবার রাত সওয়া ৯টা। কয়েক জন ছাত্র ঘোরাঘুরি করছিলেন সদর ফটকের সামনে। হঠাৎই ভারী কিছু পড়ার শব্দ। শুনে ছুটে দিয়ে দেখা যায়, মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন শৌভিক সিংহ (১৮)— কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রাশিবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০২:৫১
Share:

ভেঙে পড়েছেন শৌভিকের (ইনসেটে) মা। — নিজস্ব চিত্র।

হস্টেলের ‘ডিনার আওয়ার’ তখনও শেষ হয়নি। ছাত্রদের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে নৈশভোজ সারছিলেন ফাদাররা। শুক্রবার রাত সওয়া ৯টা। কয়েক জন ছাত্র ঘোরাঘুরি করছিলেন সদর ফটকের সামনে। হঠাৎই ভারী কিছু পড়ার শব্দ। শুনে ছুটে দিয়ে দেখা যায়, মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন শৌভিক সিংহ (১৮)— কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রাশিবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

Advertisement

কলেজের বেকবাগানের সাততলা হস্টেলের ছাদ থেকে পড়ে ওই ছাত্রের মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য দানা বেঁধেছে। কারণ, শৌভিক ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে মনে করলেও তাঁর বাড়ির লোকজন ও বন্ধুবান্ধব আত্মঘাতী হওয়ার মতো কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। কোনও সুইসাইড নোটও পাওয়া যায়নি এখনও। শৌভিকের দ্বিতীয় সেমেস্টার পরীক্ষা চলছিল। রাতে হস্টেলের ডাইনিং হল-এ তিনি অন্যদের সঙ্গে খাবারও খেয়েছিলেন বলেও পুলিশ জেনেছে।

পটনার বাসিন্দা শৌভিক মেধাবী ছাত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। বিহার থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ৯৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে বছরখানেক আগে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। প্রথম সেমেস্টারে ৭০ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়েছিলেন শৌভিক। চলতি দ্বিতীয় সেমেস্টারে দু’টো বিষয়ের পরীক্ষা বাকি ছিল। পরীক্ষা শেষ ২৫ তারিখ। তার পর দিন পটনায় যাবেন বলে শৌভিকের জন্য ট্রেনের টিকিটও কেটে রে‌খেছিলেন বাড়ির লোকজন।

Advertisement

এই দফায় শেষ পরীক্ষা হয়েছিল ১২ মে, মঙ্গলবার। তার তিন দিন পরে হস্টেলের যে ছাদ থেকে শৌভিক ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হচ্ছে, সেখানে চার ফুট উঁচু পাঁচিল ও তার উপরে তিন ফুট উচ্চতার লোহার রেলিং। পুলিশ, হস্টেল কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের বক্তব্য, অত উঁচু প্রাচীর থেকে অসাবধানতাবশত পড়ে যাওয়া মুশকিল। আবার সেই সময়ে ছাদে শৌভিক ছাড়া অন্য কেউ ছিল না বলেও প্রাথমিক তদন্ত করার পরে পুলিশের দাবি। উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ায় ওই ছাত্রের মাথা ও পা-সহ বিভিন্ন অঙ্গে আঘাতের চিহ্ন ময়নাতদন্তে পাওয়া গেলেও অন্য কোনও আঘাতের দাগ মেলেনি বলে পুলিশ জেনেছে। অর্থাৎ তাঁকে মারধর করে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণও মিলছে না।

অথচ শৌভিক আত্মহত্যা করেছেন— এমন কোনও কারণ পুলিশও পায়নি। বাড়ির লোকেরাও বুঝতে পারছেন না, শৌভিক কেন আত্মহত্যা করবেন। খবর পেয়েই শৌভিকের মা শোভা সিংহ-সহ অন্য আত্মীয়েরা শনিবার দুপুরে কলকাতায় পৌঁছন। ছেলের জন্মের বছর তিনেকের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন শোভাদেবী। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর খবর তাঁকে কী ভাবে দেওয়া হবে, প্রথমে ভেবে পাচ্ছিলেন না আত্মীয়েরা।

সব জানার পরে শোভা দেবী এ দিন জানান, মঙ্গলবার পরীক্ষার পরে রাতে শেষ বার ছেলের সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়। মা-কে শৌভিক জানান, তাঁর পরীক্ষা ভাল হয়েছে। ‘‘আমার ছেলে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিল বলে জানা নেই,’’ দাবি শোভা দেবীর। ছেলের মৃত্যু নিয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। শোভার বক্তব্য, ছেলের সঙ্গে প্রায়শই ফোনে কথা হলেও বুধ-বৃহস্পতিবার কথা হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যায় বেশ কয়েক বার তিনি ফোন করলেও শৌভিক সাড়া দেননি। এখানেই রহস্য রয়েছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

হস্টেলের অন্য আবাসিকদের বক্তব্য, অন্তর্মুখী স্বভাবের শৌভিক পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন সব সময়। হস্টেল সুপার, ফাদার পিটারের কথায় ‘‘অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল শৌভিক। পরীক্ষার মধ্যে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ভাবতেই পারছি না।’’

পুলিশ জানায়, আরও দু’জনের সঙ্গে শৌভিক থাকতেন হস্টেলের পাঁচতলার একটি ঘরে। ঘটনার সময়ে এক জন রুমমেট ছিলেন না বলে পুলিশ সূত্রের খবর। তবে কলেজের একটি সূত্রের দাবি, ঘটনার ঠিক আগে শৌভিক দুই বন্ধুর সঙ্গে পাঁচতলায় ছিলেন। টেলিফোন আসায় ওই দু’জন নীচে নামেন। তার পরেই ওই ঘটনা। তবে শৌভিকের সঙ্গে থাকা ওই দু’জন তাঁরই রুমমেট কি না, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

পুলিশ জেনেছে, ওই হস্টেলের ছাদে ওঠার দু’টি সিঁড়ি আছে। একটি সব সময় বন্ধ থাকে। অন্যটি খোলা ছিল শুক্রবার রাতে।

ছাত্রের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় অবশ্য কলেজ কর্তৃপক্ষ মুখ খোলেননি। অধ্যক্ষ ফেলিক্স রাজ একটি অনুষ্ঠানে এখন গোয়ায়। টেলিফোন এবং এসএমএসে বারবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া মেলেনি। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা এড়াতে হস্টেলের নিরাপত্তা বাড়ানো হবে কি না, সেই প্রশ্নেও মুখে কুলুপ কলেজের কর্তাদের। এ দিন কলেজে গিয়েও কারও সঙ্গে কথা বলা যায়নি। এক শিক্ষাকর্মী জানান, কলেজের যা জানানোর, তা বেনিয়াপুকুর থানাকে বলে দেওয়া হয়েছে। রাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে শৌভিকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন