অন্য দুই উড়ালপুলেও শাসকের সিন্ডিকেট রাজ

ভেঙে পড়া বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল তৈরির কাজে তৃণমূলের মদতপুষ্ট একাধিক সংস্থা সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে বলে পুলিসের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। এবং এই সূত্র ধরেই গণেশ টকিজ এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর আত্মীয় রজত বক্সীর খোঁজখবর শুরু করেছে লালবাজার। অন্যান্য সাব কন্ট্রাক্টর সংস্থার কর্তাদেরও লালবাজারে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৯
Share:

আশঙ্কা এখন এই দুই উড়ালপুল নিয়েও— জিঞ্জিরাবাজার থেকে বাটানগর এবং গার্ডেনরিচের রামনগর মোড় থেকে মোমিনপুর ছবি:অরুণ লোধ

ছবিটা সেই একই।

Advertisement

ভেঙে পড়া বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল তৈরির কাজে তৃণমূলের মদতপুষ্ট একাধিক সংস্থা সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে বলে পুলিসের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। এবং এই সূত্র ধরেই গণেশ টকিজ এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর আত্মীয় রজত বক্সীর খোঁজখবর শুরু করেছে লালবাজার। অন্যান্য সাব কন্ট্রাক্টর সংস্থার কর্তাদেরও লালবাজারে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

পুলিশকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ শহরতলিতে আরও দুই নির্মীয়মাণ উড়ালপুল তৈরির কাজেও মূল ঠিকাদার সংস্থাকে কার্যত কব্জা করে তৃণমূলেরই রমরমা চলছে। এর একটি গার্ডেনরিচের রামনগর মোড় থেকে মোমিনপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ। অন্যটি জিঞ্জিরাবাজার থেকে বাটানগর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ। দু’টি ক্ষেত্রেই শ্রমিকের পাশাপাশি যাবতীয় ইমারতি সামগ্রী সরবরাহেরও দায়িত্বে রয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা এবং তাঁদের শাগরেদরা।

Advertisement

স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, উত্তরের বিবেকানন্দ উড়ালপুলের একাংশ ভেঙে পড়েছে বলেই অনেক অজানা সত্য সামনে এসেছে। দক্ষিণের দুই উড়ালপুলকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা তৈরি হলে এখানকারও বহু কীর্তিকলাপ বে-আব্রু হয়ে যাবে।

কী রকম?

প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকার রামনগর-মোমিনপুর উড়ালপুল প্রকল্পটিকে ২০১৪ সালে অনুমোদন দেন জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম) কর্তৃপক্ষ। জমি-জট কাটিয়ে সে বছরের শেষের দিকে এর কাজ শুরু হয়। একই সময়ে ২৫৫ কোটি টাকার জিঞ্জিরাবাজার-বাটানগর উড়ালপুল প্রকল্পটিও জেএনএনইউআরএম-এর অনুমোদন পায়। দু’টি উড়ালপুলের কাজই এ বছর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের যা পরিস্থিতি, তাতে কোনও ভাবেই সময়ের মধ্যে ওই কাজ শেষ হওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কেএমডিএ-র এক কর্তা।

ওই কর্তা জানান, রাজ্যে পালাবদলের পর উড়ালপুল নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি অলিখিত নিয়ম তৈরি হয়েছে। যেমন, বিবেকানন্দ সেতুর ক্ষেত্রে তৃণমূলের হাতে থাকা কলকাতা পুরসভার ২৪ ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের কাউন্সিলরদের প্রতিনিধিরাই ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করেন। তাদেরই অন্যতম সঞ্জয় বক্সীর আত্মীয় রজতের সংস্থা সন্ধ্যামণি এন্টারপ্রাইজ। একই ভাবে দক্ষিণ শহরতলির দুই নির্মিয়মাণ উড়ালপুলের ক্ষেত্রেও মূল ঠিকাদার সংস্থাকে বাধ্য করা হয়েছে স্থানীয় পুরকর্তাদের প্রতিনিধিদের ইমারত সামগ্রী সরবরাহের বরাত দিতে। উত্তর থেকে দক্ষিণ— উড়ালপুল নির্মাণের সব কাজই এখন তৃণমূলের সিন্ডিকেটরাজের নিয়ন্ত্রণে!

স্থানীয় সূত্রের খবর, জিঞ্জিরাবাজার উড়ালপুলের কাজের জন্য বালি-সিমেন্ট-স্টোনচিপস দিয়ে মশলা তৈরির রেডিমিক্স প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে মহেশতলা পুরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডাকঘর এলাকার পেট্রোল পাম্পের উল্টো দিকে। নির্মাণকারী সংস্থার এক কর্তার দাবি, স্থানীয় সিন্ডিকেটের সদস্যরাই ওই প্ল্যান্টে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করেন। আর ওই প্ল্যান্টেই সেতুর জন্য সিমেন্টের স্ল্যাব তৈরি হচ্ছে। তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা বললেন, ‘‘মহেশতলা পুরসভার এক কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানেসিন্ডিকেটের প্রায় ৫০০ সদস্য কাঁচামাল সরবরাহের কাজে যুক্ত। ওই কাউন্সিলরই সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিচ্ছেন।’’

তৃণমূল নেতাদেরই অনেকে বলছেন, ইমারত সামগ্রীর গুণমান নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। তবু নেতাদের চাপে সে সব নিতে বাধ্য হয় নির্মাণকারী সংস্থা। তা ছাড়া, খোলা বাজার থেকে ওই সব সামগ্রী কিনলে নির্মাণকারী সংস্থা অনেক কম দামে তা পেত। সেই ক্ষতি সামাল দিতে গিয়ে সেতুর কাজে প্রভাব পড়তে পারে বলেও অনেকের আশঙ্কা।

আবার, গাডের্নরিচ এলাকায় উড়ালপুল নির্মাণে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য ৮০ নম্বর ওয়ার্ডের ধোবিতলা এলাকায় কেএমডিএ-র কয়েক বিঘা জমির উপর ‘রেডিমিক্স-প্লান্ট’ তৈরি করেছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। নির্মাণকারী সংস্থার এক কর্তার দাবি, স্থানীয় কাউন্সিলরদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই ইমারতি দ্রব্য নিতে হচ্ছে। বন্দর এলাকার তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘এখানকার তিন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরই রাজ্যের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। তাঁরাই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। নির্মাণকারী সংস্থার ওই কর্তার সাফ কথা, ‘‘চাপ তো রয়েছেই। তবে মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে কাজই বন্ধ করে দেব।’’

তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাই যে উড়ালপুলের সব কাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, তা মেনে নিয়েছেন, মহেশতলা পুরসভার চেয়ারম্যান দুলাল দাস। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সব দলের কর্মীরাই ওই নির্মাণকাজে ইরামতি দ্রব্য সরবরাহ করেন। আমাদের কোনও নেতার তত্ত্বাবধানেও তা হয়ে থাকতে পারে। তবে কোনও ভাবেই ঠিকাদার সংস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। কাঁচামালের গুণমানের বিষয়েও আমরা সজাগ।’’ কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ নিয়ে কথা বলতেই নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে সিন্ডিকেট সম্পর্কে কোনও খোঁজখবর থাকে না। কেউ অভিযোগ করলে পুলিশের কাছে যেতে বলি।’’

তবে বন্দরের এক তৃণমূল নেতার সতর্কবাণী, ‘‘কয়েকশো কোটি টাকার নির্মাণকাজে হাত লাগিয়ে কাউন্সিলরের দলবল কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে ফেলেছে। এখানে কাঁচামালের গুণমান যাচাই করা না হলে বিবেকানন্দ সেতুর মতো অবস্থা হতে পারে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন