প্রতীকী ছবি।
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির আওতায় কী কী পড়ে? পুরুষ কর্মীদের দ্বারা অবাঞ্ছিত শারীরিক স্পর্শ বা অন্য যৌন আক্রমণই নয়, যৌনভাবে রঞ্জিত রসিকতা বা টিপ্পনীও যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। এমনকি, অবাঞ্ছিত ছবি বা ভিডিয়ো ক্লিপ পাঠানোও হেনস্থা বলেই গণ্য হবে।
কাজের জায়গায় পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁর কিউবিকলে গেলেন কোনও মহিলা কর্মী। সেই সহকর্মী কম্পিউটারে তখন হয়তো ওই মহিলা কর্মীকে দেখিয়ে কোনও যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া হাসির ভিডিয়ো চালাচ্ছেন। হ্যাঁ, এই আপাত ‘নির্দোষ’ কাণ্ডটিও কিন্তু হেনস্থার পর্যায়ে পড়তে পারে। এখানে মূলমন্ত্র অবশ্যই ‘কনসেন্ট’ বা অনুমতি। সেই সহকর্মী অনুমতি সাপেক্ষে ভিডিয়োটি দেখালে অবশ্যই তা অপরাধ নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীটির বক্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অস্বস্তিতে পড়বেন জেনেও, তাঁর আপত্তি উপেক্ষা করে যদি এটা করে থাকেন সহকর্মী, তা হলে অবশ্যই তিনি সীমা লঙ্ঘন করেছেন।
কথা বলতে বলতে শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ করা, বদ রসিকতা করা— এ সবকে ‘অপরাধ’ বলতে একদা আপত্তি ছিল অনেকের। সময় বদলেছে। আর বদলেছে এই দৃষ্টিভঙ্গি, যে প্রতিবাদের কাজ শুধুই মহিলা সংগঠনগুলির। সংগঠনগুলি তৎপর হয়ে আইন পাশ করাতে পারে, কিন্তু আসলে দরকার সচেতনতা। আর প্রতিবাদের দায়টা থেকে যায় মেয়েটিরই। নির্যাতিতার মোড়কে আটকে না থেকে এই নীরবতা ভঙ্গ করা জরুরি।
ব্যক্তিগত স্তরে অবশ্য প্রতিবাদ নতুন নয়। #মিটু জোয়ার আসার ৩০ বছর আগেই রূপান দেওল বাজাজের মতো শিরদাঁড়াসম্পন্ন আইএএস অফিসার শিরোনামে এসেছিলেন কে পি এস গিলের মতো তথাকথিত পুরুষসিংহ পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে। জয়ও হাসিল করেছিলেন রূপান।
তখন এক-দু’জনের প্রচেষ্টা আলাদা করে তাঁদের চোখে পড়াত। আজ কী দেখছি? অসংখ্য মেয়ে #মিটু-র সূত্র ধরে এগিয়ে এলেন। নীরবতা ভঙ্গ করলেন। একে অপরের থেকে সাহস পেলেন। সেই কবে কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, ‘‘আমার মাথার বাইরেটা নিয়ে সবার মাথা ব্যথা, মাথার ভেতরটা নিয়ে নয়।’’ মেয়েদের মেধা ও মনন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা এই সমাজ সহজেই মেয়েদের সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের শারীরিক ছুৎমার্গহীনতাকে মিলিয়ে ফেলে। ‘কম্প্রোমাইজ’ করে মেয়েদের সাফল্য পাওয়া যেন যুগবাহিত এক সত্যের মতো মেনে নেয় এই সমাজ। অথচ যাঁরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য যৌন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন, সেই ক্ষমতাবান পুরুষদের শাস্তি দেয় না। এ যাবৎ দেয়নি সে ভাবে। এ যেন ক্ষমতাবান পুরুষদের অধিকার। তিনি অধীনস্থ মেয়েটির সঙ্গে যৌন রসিকতা করবেন, তাকে একটি শরীর হিসেবেই দেখবেন, এ যেন বিধিনির্দিষ্ট। উল্টো দিকে, উপেক্ষিত থাকে মেয়েটির নীরবতা। এর বিরুদ্ধাচরণ করার পথে বাধা অসংখ্য।
আজ বাঁধ ভেঙেছে। যা অনেকটাই আশার কথা। শুধু মুখ খুলতে পারাই একটি মেয়ের অনেক এক সাহসী পদক্ষেপ। নাম করে বা নাম না করে অনেকেই বলছেন যে কোনও উর্ধ্বতন পুরুষ সহকর্মী তাঁকে রসিকতার ঢঙে হেনস্থা করতেন, কথায় কথায় ছুঁতেন, যা মেয়েটির সম্মতি বহির্ভূতই ছিল। কেউ এ নিয়ে অভিযোগ করলেও ফল হয়নি, চাকরি ছেড়েছেন। কেউ কাজের জায়গায় উর্ধ্বতনের প্রতি সম্মান (পড়ুন প্রশ্নহীন আনুগত্য) দেখানোর যে রীতি, তা ভাঙতে পারেননি চাকরি বাঁচাতেই। মুখ বুজেই সয়েছেন হেনস্থা।
ভয় একটাই। গত পঞ্চাশ বছরে সরকারি, বেসরকারি, সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অসংখ্য মেয়ে চাকরি পেয়েছেন। মেয়েদের চাকরি করার অনুপাত আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এই লক্ষণটাই তো অতি সুলক্ষণ যে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রটা অর্ধেক না হলেও অনেকটাই দখল করে ফেলেছেন। অথচ #মিটু ঝড়ে বহু মহীরূহের পতন অনিবার্য এবং তা থেকেই ছোট-বড় গাছে সরসর হাওয়া বইছে— ভয়ের, আতঙ্কের এবং বেশ তীব্র প্রতিক্রিয়ার। মেয়েদের চাকরিতে নিলেই আবার ‘ওই সব’ ঝামেলা হবে না তো? আমরাও যখন-তখন জড়িয়ে পড়ব কি, এ সব বিশ্রী ব্যাপারে? কোনও মেয়ে অন্য কারণে আমার উপরে খাপ্পা হয়ে হুটহাট যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনে যদি? মিথ্যা অভিযোগ করে যদি? তখন তো বেশ হেসে হেসে রসিকতায় ভাগ নিচ্ছিল, দশ বছর পরে যদি হঠাৎ বলতে শুরু করে আমি হেনস্থা করেছি? কাজ করছে নানা ভয়।
এর জেরে মেয়েদের চাকরির সুযোগ কমবে কি? উল্টো কোনও লিঙ্গবৈষম্যের সূচনা হবে না তো? তা সময়ই বলবে। তবে ভয় হয়, কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক অ্যান্টি হ্যারাসমেন্ট কমিটিগুলি আজও সে ভাবে সক্রিয় নয়। আজও কোনও মহিলা কর্মী কমিটিতে নিজের সমস্যা বলতে গেলে তাকে অভিযুক্তের সঙ্গে মিটমাট করে নিতেই বলা হয় ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে। কারণ কোনও সংস্থা চায় না তাদের নাম
খারাপ হোক। এই অস্বীকার করার চেষ্টা থেকে কবে বেরোবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলি? না বেরোলে বছরের পর বছর কেটে যাবে, মাঝে মাঝে #মিটু-র ঝড় আছড়ালেও কোনও বদল হবে না। ক্ষমতাবানেরা যে ভাবে বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন, ভবিষ্যতেও সে ভাবেই ঘুরবেন। মেয়েদের ‘অবাঞ্ছিত ঝামেলা’ বা ‘সংস্থার নাম খারাপ করতে চাইছে’ বলে দূরেই ঠেলা হবে।
আর কে না জানে যে, আসলে গল্পটা ক্ষমতার?