অভিমান ভুলে গানেই আশ্রয়

প্রায় ৮৬ বছর আগের সেই স্মৃতি আজও কষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করেন সে দিনের বালক। সেই তিন বছর বয়স থেকেই তালিম নেওয়া শুরু হয়েছিল টপ্পা ও পুরাতনী বাংলা গানের শিল্পী চণ্ডীদাস মালের।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৬
Share:

সঙ্গী: স্ত্রী নমিতার সঙ্গে চণ্ডীদাস মাল। নিজস্ব চিত্র

মিনার্ভা থিয়েটারের মঞ্চ। নাটকে গাইছেন আঙুরবালা। আচমকাই দর্শকাসন থেকে তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘ছিঃ ছিঃ, তুমি হেরে গেলে শ্যাম...’ গেয়ে উঠেছিল তিন বছরের এক শিশু। তাকে থামাতে ‘বলিদান’ নাটক দেখতে আসা দর্শকেরা বলে উঠলেন, ‘ছেলে থামাও, ছেলে থামাও’। কোনও মতে সেই সময়ে একরত্তি ছেলেকে থামিয়েছিলেন বাবা।

Advertisement

প্রায় ৮৬ বছর আগের সেই স্মৃতি আজও কষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করেন সে দিনের বালক। সেই তিন বছর বয়স থেকেই তালিম নেওয়া শুরু হয়েছিল টপ্পা ও পুরাতনী বাংলা গানের শিল্পী চণ্ডীদাস মালের। আজকের অনেক নামী শিল্পীও তৈরি হয়েছেন তাঁর হাত ধরে। আজকাল অবশ্য কেউ গান শিখতে চাইলে ‘পরে ফোন করে এসো’ বলে এড়িয়ে যান ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। পরিজনদের দাবি, নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেঙ্গল মিউজিক কলেজের প্রাক্তন ওই শিক্ষক। নিয়ম করে কলকাতার কয়েকটি জায়গাতেও যেতেন গান শেখাতে।

বালির প্রিয়নাথ ঘোষ লেনের বাড়ির একতলাটা এক সময়ে ভরে থাকত ছাত্রছাত্রীতে। তিন বছর আগেও ধুতি-পাঞ্জাবি পরে সেখানে গানের তালিম দিতেন কালীপদ পাঠকের শিষ্য চণ্ডীদাসবাবু। এখন অবশ্য সেই ঘর অন্ধকার। দোতলার একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে দিন কাটে তাঁর। একমাত্র ছেলে দিল্লিতে থাকেন। বাড়িতে সঙ্গী শুধু স্ত্রী নমিতাদেবী। তিনি বলেন, ‘‘এক সময়ে কত লোক আসত। এখন হাতে গোনা কয়েক জন ছাত্রছাত্রী ছাড়া কেউ আর খোঁজ নেন না।’’

Advertisement

আর্থিক সমস্যা নেই। কিন্তু নিঃসঙ্গতাই আজ বড় সমস্যা বলে দাবি নমিতাদেবীর। তাই পরিচিত কেউ এলেই তাঁদের ফোন নম্বর লিখে রাখেন বৃদ্ধা। বললেন, ‘‘উনি তো অসুস্থ। শরীরটা খারাপ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতেও তো লোকজন দরকার।’’ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন চণ্ডীদাসবাবু। তাঁর মতো অনেক শিল্পীরই শেষ বয়সটা কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। হাওড়ার বাসিন্দা, অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ও গায়ক পান্নালাল ভট্টাচার্যও রয়েছেন সেই তালিকায়।

এ সব নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে আক্ষেপ করতে চান না প্রচার-বিমুখ চণ্ডীদাসবাবু। আক্ষেপের প্রসঙ্গ উঠলেই ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে জড়ানো স্বরে শুধু বলেন, ‘‘এখনও গান গাই তো!’’

বাবা নারায়ণচন্দ্র মালের কাছে প্রথম গান শেখা। তার পরে শিল্পী সনৎ সিংহের দাদা কিশোরীমোহন সিংহের কাছে খেয়ালের তালিম নেন চণ্ডীদাসবাবু। কিশোরীমোহনের সহযোগিতায় উত্তর কলকাতার রামচন্দ্র পালের কাছেও তিন বছর খেয়াল শি‌খেছেন। তার পর থেকে টানা ৩৫ বছর হাওড়ার বাসিন্দা কালীপদ পাঠকের কাছে গান শেখেন তিনি। ১৯৪৪ সাল থেকে আকাশবাণীতে নিয়মিত গান গাইতেন। বাঁধা ছকের বাইরে গিয়ে শৈলজারঞ্জন ঠাকুরের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে ধ্রুপদ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের থেকে ভজনের পাঠও নিয়েছেন এই শিল্পী। বেলুড় মঠেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভক্তিমূলক গান গেয়েছেন। রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমি তাঁর ১০০টি গান সংরক্ষণ করে রেখেছে।

দোতলার ছোট্ট ঘরটায় সাজানো কিছু স্মারক, পুরনো ছবি ও ক্যাসেট, রেকর্ড। গানের খাতার লালচে পাতা ছিঁড়ে গিয়েছে। হারমোনিয়ামও চাদরে ঢাকা। টিভিতে কোনও কোনও শিল্পীকে সম্মান জ্ঞাপন অনুষ্ঠান দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেন চণ্ডীদাসবাবু। নমিতাদেবীর আক্ষেপ, ‘‘অর্থটাই কি জীবনের সব! যে মানুষটা জীবনে এত কিছু দিলেন, তাঁকে আজ কেউ মনে রাখেন না।’’ তিনি জানান, ১৯৯৫ সালে তথ্যসংস্কৃতি দফতর একটা মানপত্র দিয়েছিল। সরকারি সম্মান বলতে সেটাই একমাত্র পাওনা। এ সব অবশ্য ভাবতে চান না এক সময়ের টপ্পা গানের খ্যাতনামা শিল্পী।

ঘরের কোণে থাকা তানপুরাটার তার ছিঁড়েছে। সব ভুলে সেটিতেই আঙুল ছুঁয়ে আজও তিনি গেয়ে

ওঠেন, ‘মনেরে বুঝায়ে বল, নয়নেরে দোষ কেন...।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন