এটিএম-এর নিরাপত্তারক্ষী সইফুদ্দিন শেখ (বাঁ দিকে) ও তাঁর শ্যালক মফিজুদ্দিন (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
কয়েক দিন ধরেই শরীর খারাপ। তা সত্ত্বেও তিনি মঙ্গলবার ডিউটিতে এসেছিলেন। তবে, বিকেলের পর থেকে শরীর আর মোটেও দিচ্ছিল না। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না বলে এলগিন রোডে কোটাক মহিন্দ্রার এটিএমের নিরাপত্তারক্ষী সইফুদ্দিন শেখ নিজের শ্যালক মফিজুদ্দিনকে ডেকে নিয়েছিলেন। তিনিও ওই একই সংস্থায় রক্ষীর কাজ করেন।
শ্যালককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন সইফুদ্দিন। ঠিক তখনই তিন যুবক ওই এটিএমের সামনে আসে। তাদের মধ্যে এক জন ভিতরে ঢুকে যায়। বাকি দু’জন বাইরে পাহারা দিচ্ছিল বলে মনে হয় সইফুদ্দিনের। বৃহস্পতিবার সইফুদ্দিন বলেন, “চোখে চশমা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনেক ক্ষণ ধরেই ওই যুবক ভিতরে ছিল। এটিএম-এর ভিতর কিছু একটা করছিল বলে আমার সন্দেহ হয়। চট করে কিছু বলা যায় না গ্রাহকদের। তাই কিছু ক্ষণ বিষয়টি লক্ষ করি। শেষ পর্যন্ত বিপদ আঁচ করে পাশের একটি দোকানে বিষয়টি জানাই। খবর দিই ব্যাঙ্কেও। ভবানীপুর থানাতেও খবর যায়।”
তখনও সেই যুবক এটিএমের ভিতরে তার কাজ করে যাচ্ছিল। আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা-চওড়া চেহারার একটি ছেলে সইফুদ্দিন আর মফিজুদ্দিনকে লক্ষ রাখছিল। তার সঙ্গে ছিল আর এক জন। গায়ের রঙ কালো, একটু বেটেখাটো চেহারার। মফিজুদ্দিনের কথায়, ‘‘ওরাও বুঝতে পারছিল, আমরা ওদের উপর নজর রাখছি। জালিয়াতির বিষয়টিও বুঝতে পেরে গিয়েছি। ভিতরে থাকা চশমা পরা ছেলেটিকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে বলে ওরা।’’
আরও পড়ুন: ১ লাখ তুলুন, ১৫ হাজার আপনার, এ ভাবেই চলছে জালিয়াতির ‘ম্যানেজমেন্ট স্কুল’!
ওই তিন যুবককে যে পালাতে পারে সেটাও আঁচ করতে পারেন সইফুদ্দিনরা। পাশের এক পাওভাজির দোকানদার রাজেশ সিংহকে ডেকে আনেন তাঁরা। সইফুদ্দিনের কথায়, ‘‘আমরা এটিএমের গেটের বাইরে অপেক্ষা করেছিলাম। এটিএম থেকে বেরোতেই ওই যুবককে জাপটে ধরে ফেলি। বাকি দু’জন পালানোর চেষ্টা করতেই আমিও ধাওয়া করি শরীর খারপ অবস্থায়। তবে, ওরা ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায় কেমন। ধরা পড়ে মাত্র এক জন।’’
এটুকুই পুলিশের জন্য যথেষ্ট ছিল। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “এটিএমের ভিতরে থাকা যুবক রোহিতের কাছ থেকে বাকি দু’জনের ছবি পেয়ে যাই। রেল স্টেশনগুলি ও বিমানবন্দরে আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিমানের টিকিটও কেটে ফেলেছিল আব্দুল। তার আগে সেলুনে ঢুকে দাড়িও কামিয়ে নিয়েছিল সে। যদিও তারা গুন্ডাদমন শাখার অফিসারদের চোখ ধুলো দিতে পারেনি। বিমানবন্দরেই ধরা পড়ে যায়। কলকাতার সিআইটি রোডে অন্য যুবক সুধীরকে গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়।”
এটিএম থেকে বেরোতেই এই যুবককে জাপটে ধরে ফেলেন নিরাপত্তারক্ষী। পুলিশের কাজ সহজ হয়ে যায়।—নিজস্ব চিত্র।
সইফুলউদ্দিন বুদ্ধি করে রোহিতের ছবিও তুলে রেখেছিলেন। নিজে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় তাকে ধরে ফেলেন। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “এই তিন জনই পুণে, মুম্বই এবং কলকাতায় এটিএম জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত। রোমানীয় গ্যাং-এর হয়েই তারা কলকাতার চারটি এটিএমে স্কিমার লাগানোর চেষ্টা করে। তিন শহরের পুলিশই তাঁকে খুঁজছিল।”
আরও পড়ুন: এটিএমে কী করছে এত ক্ষণ? ভিতরে ঢুকতেই জানা গেল…
সইফুদ্দিন এবং মফিজুদ্দিনকে পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। শুধু তাই নয়, তাঁদের সঙ্গে একান্তে দেখা করে সাহসিকতার ওই দুই ব্যক্তির প্রশংসাও করেছেন তিনি। খোদ পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে এমন সম্মান পেয়ে খুশি সইফুদ্দিন। তাঁর কথায়, “এমন সম্মান পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। খরচ কমানোর জন্য প্রায় সব ব্যাঙ্কই রক্ষী ছাটাই করছে। এ দিন আমরা ছিলাম বলেই কিন্তু দুষ্কৃতীরা ধরা পড়েছে। আরও দায়িত্বের সঙ্গে নিজের কাজ করার চেষ্টা করব।”
সইফুদ্দিন ১২ বছর ধরে কোটাক ব্যাঙ্কের এটিএমে কাজ করছেন। বাড়ি মুর্শিদাবাদে। কলকাতার ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের কাছে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। এ দিন অবশ্য তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি দেশের বাড়িতেই ফিরে গিয়েছেন।