৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে মহানগরের চার জায়গায় আক্রান্ত হল পুলিশ। এর মধ্যে দু’টি ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হলেও শুক্রবার রাতে মেটিয়াবুরুজ এবং রবিবার সকালে পাটুলিতে ট্রাফিক পুলিশের এক হোমগার্ডকে মারধরের ঘটনায় রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। লালবাজারের একাংশের বক্তব্য, রাজপথে এ ভাবে বারবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে শহরে আইনরক্ষকদের নিরাপত্তাই কার্যত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একই ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, দুষ্কৃতীদের মন থেকে পুলিশের ভয়ও কি উধাও হয়ে গিয়েছে?
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার বেলা এগারোটা নাগাদ পাটুলি এলাকায় ই এম বাইপাসের ঢালাই ব্রিজে হেলমেটহীন মোটরবাইক ধরার অভিযান চলছিল। সে সময়ে গোপাল হালদার নামে সোনারপুরের এক বাসিন্দাকে হেলমেট না পরে মোটরবাইক চালানোর জন্য আটকান পূর্ব যাদবপুর ট্রাফিক গার্ডের সার্জেন্ট মানবেন্দ্র বিশ্বাস এবং হোমগার্ড প্রবীর অধিকারী। গাড়ির নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করেন ওই পুলিশ অফিসার। ওই পুলিশকর্মীরা কেন তাদের আটকেছেন, এই অভিযোগ তুলে গোপাল ওই দুই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বচসা শুরু করে দেন বলে অভিযোগ পুলিশের। এক তদন্তকারী অফিসারের অভিযোগ, ওই যুবক প্রথম থেকেই খুব বেপরোয়া ব্যবহার করছিলেন। বাজেয়াপ্ত নথির তালিকায় স্বাক্ষর না করেই ওই মোটরবাইক আরোহী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান বলে জানিয়েছে পুলিশ।পুলিশ জানিয়েছে, কিছু ক্ষণ পরে গোপাল দলবল নিয়ে ফিরে আসেন। কেন তাঁর গাড়ি আটকানো হয়েছে, ওই অভিযোগ করে গোপাল এবং তার সঙ্গীরা পূর্ব যাদবপুর ট্রাফিক গার্ডের দুই পুলিশকর্মীর সঙ্গে বচসা জুড়ে দেন এবং তাঁদের নিগ্রহ করেন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, প্রবীরকে মাটিতে ফেলে মারধরও করেন গোপাল ও তার সঙ্গীরা। সার্জেন্টের মামলার নথি ছিঁড়ে ফেলে দেন। অভিযোগ, জোর করে বাজেয়াপ্ত নথিও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন অভিযুক্তেরা। এর পরেই ওই দুই পুলিশকর্মী পাটুলি থানায় খবর দিলে অতিরিক্ত বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। তত ক্ষণে অবশ্য গোপাল ও তাঁর দলবল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। প্রবীরের ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে গোপাল ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। লালবাজারের দাবি, ঘটনার পরেই গোপালদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে, তবে খোঁজ মেলেনি।
পরে প্রবীর জানান, গোপাল এবং তাঁর দলবল সার্জেন্টের উপরে চড়াও হলে তিনি ওই অফিসারকে বাঁচাতে আসেন, তখন তাঁকেও মারধর করা হয়।
কলকাতার বুকে পুলিশের মার খাওয়ার ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। আলিপুর থানায় ঢুকে হামলা চালিয়েছিলেন শাসক দলের সমর্থকেরা। সেই ঘটনার পরে লালবাজার জনা কয়েককে গ্রেফতার করলেও তাঁরা আদৌ হামলার সঙ্গে জড়িত কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল। আদালতে তার সদুত্তর দিতে পারেননি তদন্তকারী অফিসার। পুরভোটের আগে গোপালনগর মোড়ে আলিপুর থানার ওসিকে নিগ্রহ করা হলেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে ট্রাফিক কনস্টেবলকে নিগ্রহ করলেও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়নি লালবাজার।
পুলিশের একাংশ বলছে, একের পর এক এমন ঘটনা ঘটায় দুষ্কৃতীরাও আর পুলিশকে ভয় পাচ্ছে না। তার ফল মিলেছে শুক্রবার রাতে মেটিয়াবুরুজ ও নারকেলডাঙায়। শনিবার রাতে গোলপার্কের কাঁকুলিয়া রোডেও একই ভাবে পুলিশ নিগৃহীত হয়েছে। কী ঘটেছে ওই তিনটি জায়গায়?
লালবাজার সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট এবং রাজনারায়ণ স্ট্রিটে দুই গোষ্ঠীর গোলমালের খবর পেয়ে সেখানে যান নারকেলডাঙা থানার ওসি। পুলিশের গাড়ি দেখেই তাকে লক্ষ্য করে বোতল ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। বোতল এবং ইটের আঘাতে ওসির গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। ওই পুলিশ আধিকারিক আহত না হলেও খোদ ওসির গাড়িতে হামলার ঘটনায় চিন্তিত পুলিশের শীর্ষকর্তারা। পরে অবশ্য তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। ওই রাতেই মেটিয়াবুরুজ থানা এলাকার মুদিয়ালিতে একটি শোভাযাত্রা নিয়ম না মেনে এগিয়ে গেলে বাধা দেন ট্রাফিক পুলিশের এক এএসআই। অভিযোগ, সেই সময়ে শোভাযাত্রায় থাকা এক যুবক ওই অফিসারের সঙ্গে বচসা জুড়ে দেন। তাঁকে মারধরও করেন ওই যুবক।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শহরের বুকে চার জায়গায় পুলিশকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ওই মনোভাব নিয়ে চিন্তিত পুলিশকর্তারা। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “খাস শহরের বুকে তল্লাশি চালাতে গিয়ে যদি পুলিশকে এমন বাধার সামনে পড়তে হয়, তবে ধরেই নিতে হবে পুলিশের উপরে মানুষের আস্থা খুব কমে যাচ্ছে।”
একই মত কলকাতা পুলিশের বিভিন্ন থানার বহু পুলিশকর্মীরই। তাঁরা বলছেন, পুলিশ মানুষের বন্ধু হতে গিয়ে তার নিজের জায়গা থেকে সরে এসেছে। আর তার ফলেই সাধারণ মানুষ এখন আর পুলিশের উর্দি দেখলে ভয় পায় না। সেই সুযোগে পুলিশের উপরে আক্রমণ বাড়ছে। তবে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তার অভিমত, বিক্ষিপ্ত ভাবে শহরের বুকে পুলিশকর্মীরা আক্রান্ত হলেও পুলিশ তার নিজের কাজ করে যাবে।