মঙ্গলবারও জলমগ্ন বালিগঞ্জ এলাকা। ছবি: রয়টার্স।
এখনও জল নামেনি কলকাতার বেশ কিছু অংশে। তার মধ্যেই দুপুরে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির পূর্বাভাস। একটু বেশি বৃষ্টি হলে শহরের বিভিন্ন অংশ আবার বেহাল হয়ে পড়তে পারে। অবস্থা তেমন হলে পুরসভা কতটা সামলে উঠতে পারবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ সোমবার রাতের বৃষ্টিতে জমা জলই এখনও সরানো যায়নি অনেক এলাকা থেকে।
বালিগঞ্জের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির আশপাশে গড়িয়াহাট রোড জলের তলায়। বালিগঞ্জ পার্ক রোডে জল নামলেও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন এলাকা। ফলে দেখা দিয়েছে পানীয় জলের সঙ্কট। মধ্য ও উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া, আমহার্স্ট স্ট্রিট বা কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের মতো এলাকা ৩৬ ঘণ্টা পরেও জলমগ্ন রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতায় বালিগঞ্জ ছাড়াও পার্ক সার্কাসের ভিতরে বহু এলাকা এখনও জলমগ্ন। শেক্সপিয়র সরণিতেও জল পুরো নামেনি। জলমগ্ন কসবার বহু এলাকা। দক্ষিণ শহরতলির অবস্থাও অনেক জায়গায় শোচনীয়। তার মধ্যে রয়েছে পাটুলি। পাটুলির নৌকাবাজার এলাকার চারুলতা আবাসনের ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা সেন বললেন, ‘‘এখনও মনে হচ্ছে জলবেষ্টিত জাহাজে রয়েছি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমরজল। আমাদের আবাসনের চারটে সিঁড়ি জলের তলায় ছিল। এখন দুটো সিঁড়ি। কোথাও বেরোনোর সাহস পাচ্ছি না আমরা।’’
সোম আর মঙ্গলবার মিলিয়ে কলকাতা জুড়ে গড়ে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার রাতের ঘণ্টাছয়েক তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। কলকাতার এই সমস্ত এলাকায় জমা জলের সমস্যা নিয়ে কলকাতা পুরসভার একঝাঁক যুক্তি রয়েছে। বালিগঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন পার্কসার্কাস এবং তপসিয়া এলাকায় জমা জলের সমস্যার কারণ প্রসঙ্গে বিস্তর আবর্জনার কথাই বলছেন পুরকর্তারা। ওই সমস্ত এলাকার নিকাশি নালায় জমে থাকা আবর্জনার কারণেই বৃষ্টির জমা জল নামতে সময় লাগছে বলে জানিয়েছেন কলকাতা পুরসভার এক আধিকারিক।
ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘অবশ্যই জমা জল সরানোর জন্য কলকাতা পুরসভার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু নিকাশি নালায় যে ধরনের নোংরা এবং আবর্জনা জমে রয়েছে, তার জন্য ওই এলাকার মানুষকেও সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিক-সহ নানা এমন জিনিস ওই সমস্ত এলাকার নালায় রয়েছে যা জল নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যে ভারী বৃষ্টি কলকাতায় হয়েছে তা গত ২-৩ দশক প্রত্যক্ষ করেনি শহর। এমতাবস্থায় নিকাশি নালাগুলো যদি সঠিক অবস্থায় থাকতো তা হলে জল নামতে অসুবিধা হত না। এখন সময় লাগছে ঠিকই, আমরা দ্রুত সেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি।’’ এর মধ্যেই আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, বুধবার দুপুরে কলকাতা, হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
কলকাতা পুরসভা নিকাশি বিভাগের একাংশের মতে, এই জমা জল সহজে নিষ্কাশিত না-হওয়ার কারণ হচ্ছে কলকাতা পুরসভার সংযোজিত এলাকা। কোনও রকম নিকাশি পরিকল্পনা না-করেই যাদবপুর, সন্তোষপুর, গাঙ্গুলিবাগান, গড়িয়া, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ, বেহালা, বড়িশা, ঠাকুরপুকুর, জোকার মতো এলাকাকে কলকাতা পুরসভার অধীনে আনা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে কলকাতা পুরসভা ওই সব এলাকায় নিকাশি নালা তৈরির কাজ নতুন করে করছে। বেহালা ও বড়িশার বেশ কিছু এলাকায় কেইআইপি নতুন নিকাশি নালা তৈরির কাজ করেছে বলে জমা জলের সমস্যা খুব বড় আকারে দেখা যায়নি। কিন্তু যে সমস্ত এলাকায় এখনও নিকাশি নালার কাজ হয়নি সেই এলাকাগুলোর জন্যই মূলত কসবা ও বালিগঞ্জ এবং পার্ক সার্কাস এলাকায় জমা জলের সমস্যা তৈরি হয়েছে।
পুরকর্তারা উদাহরণস্বরূপ বলছেন, ৬৬ ও ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড, অর্থাৎ কসবা, বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস আগে থেকেই কলকাতা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮৫ সালে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস সংলগ্ন এলাকাগুলিকে পুরসভার অধীনে আনা হয়। ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১০ নম্বর ওয়ার্ডগুলি এর পরে তৈরি হয়ে কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই সব এলাকাগুলিতে নিকাশি ব্যবস্থা এখনও সে ভাবে তৈরি হয়নি। তাই সেই সব ওয়ার্ডগুলির জমা জলের চাপ খানিকটা হলেও বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাস, কসবা এলাকার আদি কলকাতার ওয়ার্ডগুলিকে নিতে হচ্ছে। যার ফলে জল জমার সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কলকাতা পুরসভার নিকাশি বিভাগের মেয়র পরিষদ তারক সিংহের কথায়, ‘‘কলকাতা পুরসভার সংযুক্ত ওয়ার্ড নিয়ে সমস্যার কথা বললে অনেকেই আমার বিরুদ্ধে রাজনীতি করার অভিযোগ আনবেন। বলবেন আমি আমাদের ব্যর্থতার দায় বামফ্রন্ট সরকারের উপর চাপানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করলেই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন আসলে সমস্যাটা কোথায়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘১ থেকে ১০০ ওয়ার্ড পর্যন্ত কলকাতা পুরসভা এলাকায় ছিল। পরে কারা ১০১ থেকে ১৪১ ওয়ার্ডকে কলকাতা সঙ্গে যুক্ত করেছিল তা সবাই জানেন। তারা কোনও রকম নিকাশির পরিকল্পনা ছাড়াই এই এলাকাগুলিকে কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যুক্ত করায় সমস্যাগুলি ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দেয়। মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নেতৃত্বে আমরা ধীরে ধীরে সংযুক্ত এলাকায় নতুন করে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলছি। সেই ফল শহর কলকাতা আগামী দিনে পাবে।’’
শহরের সাধারণ নাগরিকেরা অবশ্য এই ‘আগামী দিন’ নিয়ে এই মুহূর্তে ভাবার অবস্থায় নেই। জলে ভাসা এলাকাগুলিতে একটাই জিজ্ঞাসা, এই জল কখন নামবে? কখন ফিরবে বিদ্যুৎ? আবার বেশি বৃষ্টি হলে কী হবে? পুজোতেই কি জলেই বাস করতে হবে? প্রশ্ন অনেক। উত্তর সম্ভবত কারও জানা নেই।