খোলা-বন্ধে বিভ্রান্তি বাড়াল ব্যাঙ্ক

নামেই ছুটির দিন, কিন্তু আরাম-আয়েশের সুযোগ নেই। রবিবার কাজে ব্যস্ত থেকেই কাটাল কলকাতা। কাজ মানে নগদ টাকা তুলতে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪২
Share:

যুদ্ধ নয়, টাকা তোলা। রবিবার, মহেশতলায়। ছবি: অরুণ লোধ

নামেই ছুটির দিন, কিন্তু আরাম-আয়েশের সুযোগ নেই। রবিবার কাজে ব্যস্ত থেকেই কাটাল কলকাতা।

Advertisement

কাজ মানে নগদ টাকা তুলতে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো। কোথাও ব্যাঙ্কের সামনে লাইন পড়েছে ভোর পাঁচটা থেকে। আজ, সোমবার গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষে ব্যাঙ্ক বন্ধ। সে জন্য এ দিন টাকা তুলতে ভিড় ও মানুষের তাগিদ ছিল গত তিন দিনের তুলনায় বেশি। তবে এক-একটি ব্যাঙ্কের এক-এক সময়ে ঝাঁপ ফেলা ভোগান্তি বাড়িয়েছে।

এ সবের মধ্যেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে মানুষের একাংশের। শ্যামবাজারে ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় দুপুর ২টো নাগাদ ব্যাঙ্ককর্মীদের সঙ্গে হঠাৎ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন কয়েক জন গ্রাহক। অভিযোগ, বেশ কয়েক জন লাইনে না দাঁড়িয়েও ফাঁকতালে ঢুকে পড়ে টাকা তুলে নিচ্ছিলেন। সন্ধ্যায় গার্ডেনরিচের পাহাড়পুরে ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সামনে লাইনে দাঁড়ানো লোকজন নিজেদের মধ্যেই হাতাহাতিতে জড়ান। মঙ্গলবারের জন্য ব্যাঙ্ক সেখানে অগ্রিম টোকেন দিচ্ছিল। ওই টোকেন নিয়ে ব্যাঙ্ককর্মীরা বাইরে বেরোতেই তা সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি ও মারামারি। পরিস্থিতি সামলাতে গার্ডেনরিচ থানার ওসি-কে বিশাল বাহিনী নিয়ে সেখানে ছুটে যেতে হয়।

Advertisement

ব্যারাকপুরের বি এন বসু মহকুমা হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে এক রোগীর পরিজনেরা ১৫ টাকার ওষুধ নিয়ে ৫০০ টাকার নোট দিলে তা নিতে অস্বীকার করেন দোকানের কর্মী। শুরু হয় বচসা। এর জেরে ওই রোগীর পরিজনেরা দোকানের কাচ ভেঙে দেন বলে অভিযোগ।

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ তপসিয়ায় অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক জানায়, লিঙ্ক নেই। টাকা দেওয়া যাবে না। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পরে টাকা না পেয়ে ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তার ডিভাইডারে ভাঙচুর চালায়। পথ অবরোধও হয়। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ যায়। অবরোধের ফলে বেশ কিছুক্ষণ যানজট হয় এলাকায়।

একেই বহু মানুষ মেজাজ ঠিক রাখতে পারছেন না, তার উপরে এক-এক সময়ে এক-একটি ব্যাঙ্ক, এমনকী একই ব্যাঙ্কের এক-একটি শাখা এক-এক রকম সময়ে বন্ধ হওয়ায় সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। টালিগঞ্জের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডে সাকুল্যে দেড়শো মিটার দূরত্বে চার-চারটি ব্যাঙ্ক— তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত, একটি বেসরকারি। টালিগঞ্জে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডের ওই চারটি ব্যাঙ্কের এক-একটি রবিবার এক-এক রকম সময়ে ঝাঁপ বন্ধ করেছে। এসবিআই বিকেল চারটেয়, এইচডিএফসি সাড়ে তিনটেয়, ইউকো ব্যাঙ্ক বিকেল পাঁচটা আর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সন্ধে ৬টায় পরিষেবা বন্ধ করেছে। ফলে ভুগতে হয়েছে বৈধ নোট হাতে পেতে মরিয়া মানুষদের। শুধু ওই জায়গা নয়, বিবেকানন্দ রোড, বৌবাজারেও একই কারণে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়েন।

এইচডিএফসি-র টালিগঞ্জ শাখায় গত তিন দিন টাকা তুলতে না পারা এক গ্রাহক রবিবার স্নান-খাওয়াদাওয়া করে সাড়ে ১২টা নাগাদ ফের এসেছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দাঁড়াতে হলেও চেক কেটে দশ হাজার টাকা তুলতে পারবেন, এমনটাই তাঁর আশা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মী ব্যাঙ্ক চত্বরে ঢোকার লোহার ফটকই খোলেননি। আর তখন যা লাইন, সবই ওই ফটকের ভিতরে, চত্বরের মধ্যে। হতাশায় ভেঙে পড়লেন ওই গ্রাহক।

রক্ষীর বক্তব্য, ‘‘আজ বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ব্যাঙ্ক খোলা। গতকালই সেই নোটিস ব্যাঙ্কের দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। লোহার গেটের ভিতরে এখন যত জনের লাইন, সাড়ে তিনটে পর্যন্ত তাঁদের সকলে পরিষেবা পাবেন কি না, সেটাই সন্দেহ। সে জন্য আর কাউকে আমরা ঢুকতে দিচ্ছি না।’’ এমনটা কেন হল? ওই ব্যাঙ্কের এক অফিসার বলেন, ‘‘শনিবার হেড অফিস থেকে লিখিত বার্তায় আমাদের বলা হয়েছে, সাধারণ দিনে যতটা সময় পর্যন্ত ব্যাঙ্ক খোলা থাকে, রবিবার সেটাই থাকবে। আর আমাদের ক্ষেত্রে সেটা সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত। আমরা সেটা মেনে চলেছি।’’

ব্যাঙ্কগুলো মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে এই অস্বাভাবিক অবস্থায় তাদের পরিষেবার ফিরিস্তি দিলেও রবিবারের সময় সম্পর্কে কিছু জানায়নি। এইচডিএফসি গা-ঘেঁষা স্টেট ব্যাঙ্ক জানাল, রবিবার ব্যাঙ্ক খোলা বিকেল চারটে পর্যন্ত। অদূরেই ইউকো ব্যাঙ্কের টালিগঞ্জ শাখা। ম্যানেজার উমা ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘আমাদের কাছে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ আছে।’’ আবার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের রিজেন্ট পার্ক শাখার এক কর্মী বললেন, ‘‘আজও সন্ধে ৬টা পর্যন্ত ব্যাঙ্ক খোলা।’’ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কয়েকটি শাখা এ দিন খোলা ছিল বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আবার সেই ব্যাঙ্কেরই বৌবাজার শাখা বন্ধ হয়ে যায় বিকেল তিনটেয়। একই সময়ে বন্ধ হয় বিবেকানন্দ রোডের ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক।

যদিও রাজ্যের স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির এক সদস্য দাবি করেন, রবিবারও যতক্ষণ মানুষের লাইন ছিল, ততক্ষণ ব্যাঙ্ক পরিষেবা দিয়েছে। তবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা ছিল, শনি ও রবিবার ব্যাঙ্কের নির্ধারিত সময় অনুযায়ীই ব্যাঙ্ক পরিষেবা দেবে। বর্ধিত সময়ে পরিষেবা দেওয়ার কথা ছিল না।

আবার এক-একটি ব্যাঙ্ক নগদ দেওয়ার ক্ষেত্রেও এক-এক রকম নীতি নিয়েছে। সাধারণ ভাবে সব ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, যতক্ষণ তাদের হাতে নগদ থাকবে, অচল নোট বদলানো ও অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কেটে টাকা তোলা যাবে। অথচ এ দিন বেলা সাড়ে ১২টায় ইউকো ব্যাঙ্কের টালিগঞ্জ শাখা জানায়, নোট বদল হবে না, শুধু টাকা তোলা যাবে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের বক্তব্য, ‘‘নোট বদলের সময়ে প্রায় সকলেই ১০০-র নোট চাইছেন। অথচ আমাদের কাছে ২০০০ টাকার নোট বেশি পাঠানো হচ্ছে। ফের ১০০ টাকার নোট না আসা পর্যন্ত নোট বদলাতে পারব না।’’

ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার যোধপুর পার্ক শাখায় এ দিন কারেন্সি চেস্ট থেকে ৬০ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০০০-এর নোটে দেওয়া হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা, বাকি ২০ লক্ষ টাকা ১০০-র নোটে।

এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের ম্যাডক্স স্কোয়্যার শাখায় সকাল সাড়ে আটটায় লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর দেড়টায় অচল নোট বদল করে অবশ্য সব ১০০-র নোটই পেলেন মধ্যবয়সী শোভা চক্রবর্তী। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, সল্টলেকের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব প্রদীপ্ত বসু অতটা ধৈর্য রাখতে পারেননি। এসবিআইয়ের সামনে ঘণ্টা দুয়েক লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই বয়সে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ছেলে বিদেশে থাকে। আমাকে কে টাকা তুলে দেবে?’’ অনেকেরই দাবি, প্রবীণদের জন্য পৃথক লাইনের ব্যবস্থা করলে ভোগান্তি কিছু কমবে। বিশেষত সল্টলেকে যেখানে বহু প্রবীণ নাগরিক বসবাস করেন।

কিছু জায়গায় পারস্পরিক সহযোগিতার ছবিও দেখা গিয়েছে। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তাঁরা না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন কী করে? এক-এক জন খাবার কিনতে বা খেতে যাচ্ছেন তাঁর পিছনের মানুষটিকে বলে, তাঁর সম্মতি নিয়ে।

টাকা তুলতে এন্টালিতে কানাড়া ব্যাঙ্কের সামনে রবিবার ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন গ্রাহকরা। গ্রাহকদের অধিকাংশই জানান, ছুটির দিন হওয়ায় তাঁরা টাকা তোলার জন্য রবিবারটাই বেছে নিয়েছেন।

তবে সোনারপুর স্টেশন লাগোয়া এসবিআইয়ে পেনশনের টাকা তুলতে এ দিন দুপুর ১২টায় লাইন দিয়ে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়েও লাভ হয়নি এক স্কুল শিক্ষকের। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ব্যাঙ্কের তরফে বলা হয়, আর টাকা দেওয়া হবে না। এর পরেই জনতা বিক্ষোভ শুরু করে। অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষকের কথায়, ‘‘আমি হৃদ্‌রোগী। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়েও টাকা পেলাম না। সোমবার ছুটি। কবে টাকা পাব, জানি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন