আত্মীয় সেজে গর্ভ ভাড়া, দরাদরিও!

সন্তানের আকাঙ্ক্ষা। কলকাতা জুড়ে ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। সেখানে হচ্ছেটা কী? গর্ভ ভাড়া দেওয়া নিয়ে কিছু বিধিনিষেধের কথা তো সরকার বলেছে। ভয় করে না? দাপুটে উত্তর আসে, ‘‘আত্মীয় হলে জন্ম দেওয়াই যায়। তাই আত্মীয় সেজেই কাজ করি। টাকাও আগের থেকে বেশি এখন।’’

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৮ ০২:৫৫
Share:

দশ টাকায় সারা জীবন বসে খান!

Advertisement

এমনই হাঁক পেড়ে পাড়ায় পাড়ায় পিঁড়ি বিক্রি করেন স্বামী।

স্ত্রী কিন্তু দু’-দু’বার সিঙ্গাপুর ফেরৎ। কারণ, তিনি ‘সারোগেট’ বা গর্ভদাত্রী মা। গর্ভ ভাড়া দিয়ে বেশ কয়েক জনের জন্ম দিয়েছেন। নিজের সন্তান একটি।

Advertisement

তবে ফোনে যোগাযোগের শর্তই ছিল, নাম-পরিচয় জানা যাবে না। যতটুকু নিজে বলবেন, শুনতে হবে ততটুকুই। গর্ভদাত্রী মা জানালেন, স্বামীর অল্প আয়ে চলে না সংসার। তাই পাড়ার এক দিদির বুদ্ধিতে এই কাজ শুরু।

গর্ভ ভাড়া দেওয়া নিয়ে কিছু বিধিনিষেধের কথা তো সরকার বলেছে। ভয় করে না? দাপুটে উত্তর আসে, ‘‘আত্মীয় হলে জন্ম দেওয়াই যায়। তাই আত্মীয় সেজেই কাজ করি। টাকাও আগের থেকে বেশি এখন।’’

কত টাকা পান? কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। কনফারেন্স কলে যিনি যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন, শহরের এক আইভিএফ ক্লিনিকের সেই কর্মীই দিলেন উত্তর, ‘‘কেস পিছু টাকা আলাদা। কোনও সেন্টারের হয়ে কাজ করলে অনেকটা ‘কাট মানি’ দিতে হয়। আর সোজাসুজি কোনও ‘পার্টি’ পেলে ব্যাপারটা অন্য রকম।’’ তথ্য বলে, ‘সারোগেসি’র মাধ্যমে সন্তান পেতে খরচ কোথাও ৫-১০ লক্ষ, কোথাও ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা। এই কাজের সূত্রেই তো ফোনের ও-পারের নাম না জানা ওই মহিলা বার দুই ঘুরে এসেছেন সিঙ্গাপুরে।

‘সারোগেট’ সন্তানের জন্মভূমি হিসেবে গুজরাতের পাশাপাশি জনপ্রিয় কলকাতাও। বিশেষত ভিনদেশি দম্পতিদের কাছে। তবে দরিদ্র মহিলাদের বাঁচাতে ২০১৬ সালে আনা হয় একটি বিল। বলা হয়, সন্তানধারণে শারীরিক ভাবে অক্ষম ভারতীয় দম্পতিদের জন্যই শুধু এই ব্যবস্থা চালু থাকবে। বিয়ের পাঁচ বছর পরে যে দম্পতি শারীরিক অসুবিধের কারণে সন্তানধারণ করতে পারেননি, তাঁরা ‘নিকটাত্মীয়ের’ সাহায্য নিতে পারেন। তবে আত্মীয়েরও অর্থলাভ হবে না। হাসপাতাল এবং আনুষঙ্গিক খরচ বহন করবেন হবু অভিভাবকেরা। রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হবে দু’তরফকেই। তবে গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রে গর্ভদাত্রীর ইচ্ছেই শেষ কথা। সঙ্গে লাগবে সরকারি অনুমতি।

এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘বিল এখনও পাশ না হলেও রাখঢাক বেড়েছে। সারোগেসি এখন চলে মেঘের আড়াল থেকে।’’ শহরের এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসক জানালেন, সারোগেসি সেন্টার হিসাবে নাম করেছিল যে সব কেন্দ্র, সে সবই এখন চলে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে।

আরও পড়ুন: বাড়ি থেকে ‘উৎখাত’ এইচআইভি পজিটিভ

উত্তর শহরতলির তেমন একটি ক্লিনিকে গিয়ে জানানো গেল, কোনও মহিলার গর্ভ ভাড়া নিয়েই সন্তানের জন্ম দেওয়ার ইচ্ছের কথা। রিসেপশনের কর্মীর প্রকাশ্যে উত্তর, ‘‘তাতে অনেক ঝামেলা!’’ তবে কাজ যে হবে, তা তিনি বুঝিয়েও দিলেন বরাভয়-মুদ্রা দেখিয়ে। দক্ষিণ কলকাতার এক ক্লিনিকের কর্মী আবার সোজাসাপ্টা, ‘‘কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে শুরু করে সারোগেট মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করানো— সবই করি। তবে প্যাকেজটা অনেক বেশি। তিন থেকে পাঁচ লক্ষ গর্ভদাত্রীই নেবেন। অন্যান্য খরচও আছে।’’

তবে শহরের এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের অভিযোগ, যে বিকল্প মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিল এসেছিল, তাঁদেরই অনেকে ‘মুনাফা লুটছেন’। এক আইভিএফ ক্লিনিকের কর্মী যেমন বললেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত কেউ রাখবে না আপনার সন্তান। মাঝ পথে থানা-পুলিশের ভয় দেখিয়ে গর্ভপাত করিয়ে নেবে। আপনার টাকাটা যাবে।’’ আর এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসক জানাচ্ছেন, কোনও ক্লিনিক বা চিকিৎসকের মাধ্যমে ‘সারোগেট’ মায়ের সঙ্গে কথা হওয়ার সময়ে খরচের হিসেব থাকে একরকম। তার পরে নানা বাহানায় বাড়তে থাকে চাহিদা। তাঁর কথায়, ‘‘ছ’মাসের মাথায় যদি কোনও মহিলা বলেন, গর্ভধারণের বাকি সময় মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে রাখতেই হবে তাঁকে! তত দিনে আপনার কয়েক লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনার সন্তানও ওই মহিলার গর্ভে। তাঁকে চটাতে পারবেন না। কী করবেন তখন?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন