নিখরচার চিকিৎসা দূর অস্ত্, শয্যাই জুটল না দুঃস্থ রোগীর

মরণাপন্ন রোগীকে যদি সরকারি হাসপাতাল ভর্তি না নেয় এবং যদি তাঁর পরিবারের বেসরকারি হাসপাতালে লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকে, তা হলে সেই রোগীর ভবিষ্যৎ কী?

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০২:০৯
Share:

প্রত্যাখানের একটি নজির। আছে আরও।

মরণাপন্ন রোগীকে যদি সরকারি হাসপাতাল ভর্তি না নেয় এবং যদি তাঁর পরিবারের বেসরকারি হাসপাতালে লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য না থাকে, তা হলে সেই রোগীর ভবিষ্যৎ কী? ওই রোগীকে কি তা হলে বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে হবে?

Advertisement

যে রাজ্যে দরিদ্রদের চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ ও অস্ত্রোপচার ‘ফ্রি’ করা হয়েছে সেখানেই এই প্রশ্ন তুলছেন হাওড়ার দরিদ্র এক দিনমজুর মহাদেব কোলের পরিবার। বলেছেন, ‘‘ভর্তিই যদি না হতে পারেন, তা হলে আর গরিব রোগী নিখরচায় পরিষেবার সুবিধা নেবেন কী করে?’’

পুকুর ঘাটের বাঁধানো সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে মেরুদণ্ড ও সুষুণ্মাকাণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন মহাদেববাবু। মুখটুকু ছাড়া শরীরের বাকি অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে। ওই অবস্থায় তাঁকে নিয়ে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে কলকাতার তিন-তিনটি নামী মেডিক্যাল কলেজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আত্মীয়-প্রতিবেশিরা। প্রত্যেকটি হাসপাতালই লিখে দিয়েছে, রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি করা প্রয়োজন। আবার তারাই পাশে লিখেছে— শয্যা খালি নেই। ‘রিগ্রেট, নো বেড।’ প্রত্যেকেরই পরামর্শ, ‘অন্য কোনও মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালে চেষ্টা করুন।’

Advertisement

দু’টি ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাদেববাবুর স্ত্রী-র পক্ষে আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে বেড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে বিনা চিকিৎসায় হাওড়ার বাঙ্গালপুর-এর বাড়িতে পড়ে রয়েছেন মহাদেববাবু। ওই হাসপাতালে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে তাঁর স্ত্রী অর্চনা কোলে এবং দাদা রবীন কোলে প্রশ্ন তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কোনও মুমূর্ষুকে হাসপাতাল ফেরাতে পারে না। সেটা শাস্তিযোগ্য। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনও রোগীকে প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। তবে কেন মহাদেববাবুকে ফেরানোর জন্য হাসপাতালগুলির শাস্তি হবে না?

কয়েক দিন ধরে কথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে মহাদেববাবুর। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। স্নায়ু চিকিৎসকদের মতে, পক্ষাঘাত মস্তিষ্কে চলে গেলে রোগীকে বাঁচানো মুশকিল হবে। বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির প্রাক্তন অধিকর্তা নিউরোসার্জন শ্যামাপদ গড়াইয়ের কথায়, ‘‘এই ধরনের রোগী বিনা চিকিৎসায় বাড়িতে পড়ে থাকলে বেডসোর হবে। ক্যাথিটার থেকে সংক্রমণও হতে পারে। তার পরের আশঙ্কা শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ হওয়ার। সেটা আরও বাড়লে হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হতে পারে।’’ মহাদেববাবুর স্ত্রী দশ বছর ও ছ’বছরের দুই সন্তানকে আঁকড়ে শূন্য চোখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আমরা খুব গরিব। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পয়সা নেই। চিকিৎসা ছাড়াই কি আমার স্বামী মরে যাবে? আমাদের কী হবে? মুখ্যমন্ত্রী কি কিছু করতে পারেন না?’’

স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কর্তাই স্বীকার করেছেন, একা মহাদেববাবু নন, নিউরোসার্জারির অধিকাংশ রোগীকে সরকারি হাসপাতালে এলে একই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কারণ যতই এ রাজ্যে মাল্টি স্পেশ্যালিটি-সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হোক না কেন, যে ক’টি মেডিক্যাল কলেজ আগে থেকে রয়েছে, সেগুলিতেই নিউরোসার্জেনের ভয়ানক আকাল। শয্যাও কম।

রাজ্যে একমাত্র যে হাসপাতালে শুধু স্নায়ুরোগ ও স্নায়ুর আঘাত সংক্রান্ত চিকিৎসা হয়, সেটা এসএসকেএম সংলগ্ন ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি’ (বিআইএন)। কিন্তু সেখানেও ইমার্জেন্সি বেড মাত্র ৪০টি। এই রোগীদের জন্য সিসিইউ-ও কম। গোটা রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের একটি প্রবণতাই হল, স্নায়ুর আঘাতের রোগী হলেই বিআইএন-এ রেফার করে দেওয়া। স্বভাবত এখানে শয্যা পাওয়া মানে লটারি পাওয়ার সামিল। আশা করা হয়েছিল, এসএসকেএম হাসপাতালের সহযোগী হিসেবে রামরিক হাসপাতাল সংষ্কারের পরে ফের চালু হলে সেখানে নিউরোসার্জারির কিছু শয্যা চালু হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, সেখানেও আপাতত নিউরো মেডিসিনের ৫০টি
শয্যা খোলা হবে।

রাজ্য সরকার তিনটি ট্রমা কেয়ার সেন্টার তৈরি করবে বলেছিল। সেগুলি হওয়ার কথা ছিল আরজিকর, এসএসকেএম, এম আর বাঙুর-এ। শুরু হওয়ার কথা ছিল আরজিকর দিয়ে। বলা হয়েছিল, মূলত দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ড ও মাথার আঘাতের কেসগুলি এখানে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা হবে ও অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে চেষ্টা করে এখনও পর্যন্ত আরজিকরের ট্রমা সেন্টারে ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচার চালু করা যায়নি। ফলে মহাদেববাবুর মতো রোগীদের হাসপাতালে-হাসপাতালে ঠোক্কর খেয়ে বেড়াতে হয়।

মহাদেববাবুর দুর্ঘটনা ঘটেছিল গত ১০ অক্টোবর, নবমীর দিন। প্রথম দু’দিন তাঁকে হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। বিল ওঠে ৫৪ হাজার টাকা। পাড়ার লোক চাঁদা তুলে সেই বিল মেটায়। এর পরে আর এই খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। প্রতিবেশী সত্যানন্দ ঘোষ, তরুণ মণ্ডল, মানস মল্লিকদের অভিযোগ, ১৩ অক্টোবর মহাদেববাবুকে বিআইএন-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা ভর্তি জরুরি লিখেও শয্যা নেই বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এই নিয়ে বিআইএনের অধিকর্তা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ‘‘ব্যস্ত আছি’’ বলে ফোন নামিয়ে দেন।

এর পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেও অ্যাডমিশন লেখা হয়। তার পরে বলা হয়, শয্যা নেই। নীলরতনের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘যদিও আমাদের রোগীর মারাত্মক চাপ এবং এই ধরনের আঘাতের রোগীকে মাটিতে বা ট্রলিতে ভর্তি করা যায় না। তবু প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত হয়েছে। অন্য কোনও বিভাগের শয্যায় তখনকার মতো ভর্তি করে পরে নিউরোসার্জারিতে স্থানান্তর করা যেত। আসলে
অনেক চিকিৎসকই রোগী ভর্তির দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন।’’

মহাদেববাবুকে এর পরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আরজিকর হাসপাতালে। অভিযোগ, সেখানে চিকিৎসকেরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পরের দিন আউটডোরে আসতে হবে। বাড়ির লোক তখন জানিয়েছিলেন, এই রোগীকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে ফের পরের দিন সকালে ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব। তাঁদের অভিযোগ, চিকিৎসকেরা তখন বলেছিলেন, ‘সেটা আপনাদের ভাবার বিষয়, আমাদের নয়।’ আরজিকর-এর অধ্যক্ষ শুদ্ধদন বটব্যাল জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন