ভবঘুরে যুবকের পরিচর্যায় একজোট পাড়া

এক সময়ে বিরাটি হাইস্কুলের কৃতী ওই ছাত্রের স্বপ্ন ছিল বিদেশে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হবেন। কিন্তু সতেরো বছর আগের ঘটনা সব কিছু বদলে দেয়। বাবার অকস্মাৎ মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে মানসিক অসুস্থতার শিকার হন যুবক।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১৪
Share:

—প্রতীকী চিত্র

মেধাবী ছাত্রটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভবঘুরে হয়ে গিয়েছিলেন। অসুস্থ সেই যুবককে সুস্থ করে তুলতে একজোট হল গোটা পাড়া। তাতে সেতুবন্ধনের ভূমিকায় থাকল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। বস্তুত, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় কী ভাবে সমাজের এগিয়ে আসা উচিত তার দৃষ্টান্ত তৈরি করল বিরাটি।

Advertisement

এক সময়ে বিরাটি হাইস্কুলের কৃতী ওই ছাত্রের স্বপ্ন ছিল বিদেশে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হবেন। কিন্তু সতেরো বছর আগের ঘটনা সব কিছু বদলে দেয়। বাবার অকস্মাৎ মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে মানসিক অসুস্থতার শিকার হন যুবক। নোংরা, দুর্গন্ধময় জামা পরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর সময়ে প্রায়ই তাঁকে উত্ত্যক্ত করা হত। নোংরা জামাকাপড় নিয়ে আবাসিকদের আপত্তিতে এক সময়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকাও বন্ধ হয়ে যায় যুবকের।

সম্প্রতি উত্তর দমদম পুরসভার উদ্যোগে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তত্ত্বাবধানে পুর এলাকার বাসিন্দাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ‘জনমানস’ নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। সেই কাজ চলাকালীন এক দিন ভবঘুরে যুবকের সঙ্গে দেখা হয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি তিলোকা মুখোপাধ্যায়ের। তার আগে স্থানীয় সিপিএম কাউন্সিলর শ্যামল মজুমদারও ওই যুবকের জন্য কিছু করার আর্জি জানিয়েছিলেন। নাম কী, বাড়িতে কারা আছেন, কত দূর পড়াশোনা— আন্তরিক ভাবে এমন কিছু প্রশ্ন করতেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন সেই যুবক। বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় হলে যুবক চিকিৎসা করাতেও রাজি হন। তাঁকে প্রথমে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পরিজন বা ‘কেয়ারগিভার’-এর জটিলতায় সেখানে রাখা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে যুবককে নিজেদের কাছে রেখে চিকিৎসা করাতে রাজি হন চেতলার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেখানে চিকিৎসার পরে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন যুবক।

Advertisement

আবাসিক এবং প্রতিবেশীদের আপত্তির কারণে যুবককে বাড়ি ফেরানো সহজ ছিল না। স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতায় পাড়ার কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশীদের বোঝানোর কাজ প্রথমে শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি সৃজা চক্রবর্তী, ডালিয়া রাহারা। কয়েক দফা বৈঠকের পরে যুবককে কাছে টানার প্রশ্নে যে প্রতিরোধ ছিল তা ভাঙতে শুরু করে। এর পরে গোটা পাড়া ব্যতিক্রমী হতে সময় নেয়নি। আবাসিক এবং‌ পাড়ার বাসিন্দাদের একটি অংশ চাঁদা তুলে যুবকের আপাতত যে খরচের প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর দেখাশোনার জন্য এক জন আয়াকে রাখা হয়েছে। তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি চলে গেলে যুবকের খেয়াল রাখছেন তাঁর সামনের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে মনোরোগীদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চান না পরিজনেরা। সেখানে বিরাটির ঘটনা ইতিবাচক, মানছেন মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত সমাজকর্মীরা।

আবাসনের সম্পাদক বিজন সরকারের বক্তব্য, ‘‘প্রত্যেকে ওঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। সবাই মিলে চেষ্টা করছি যাতে ওঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায়।’’ শ্যামলকান্তিবাবু বলেন, ‘‘একটা শিক্ষিত ছেলের জীবন এ ভাবে নষ্ট হবে এটা মেনে নিতে পারিনি। সম্পূর্ণ সুস্থ হলে ওঁর কাজের ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করালে ভাল হত।’’

সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘এক জন মনোরোগীর চিকিৎসা এ ভাবেই হওয়া প্রয়োজন। আবাসিক, প্রতিবেশী, স্থানীয় কাউন্সিলর, পুর প্রধান, চেতলার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি যে ভাবে এগিয়ে এসেছে তাও প্রশংসনীয়। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে এই সামগ্রিক চেষ্টাই কাম্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন