পাতালের অন্ধকূপে বন্দি রইলাম ঝাড়া দেড় ঘণ্টা

বেলা ১১টা ২০ মিনিট ময়দান স্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন এগোচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের দিকে। কিন্তু হঠাৎই থেমে গেল সুড়ঙ্গের মধ্যে। মেট্রোয় এমন হয় মাঝেমধ্যেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফের চলতে শুরু করে ট্রেন। এ দিনও তেমনই হবে ভাবছিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে কয়েক মিনিট হয়ে গেল, ট্রেন নড়ে না। পাশের ডাউন লাইন দিয়ে ঝম ঝম করে বেরিয়ে গেল তিনটি ট্রেন। এ বার একটু ঘাবড়ে গেলাম। কোনও ঘোষণা নেই। কী হয়েছে, তা-ও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মোটরম্যানদের তরফেও কোনও ঘোষণা নেই। কেবল মাঝে মাঝে স্পিকারে শোনা যাচ্ছে, ‘প্লিজ ওয়েট’।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৪:০৭
Share:

কামরায় আটকে অসুস্থ হয়ে পড়া যাত্রীর শুশ্রূষা। সোমবার, পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের বাইরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

বেলা ১১টা ২০ মিনিট

Advertisement

ময়দান স্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন এগোচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের দিকে। কিন্তু হঠাৎই থেমে গেল সুড়ঙ্গের মধ্যে।

মেট্রোয় এমন হয় মাঝেমধ্যেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফের চলতে শুরু করে ট্রেন। এ দিনও তেমনই হবে ভাবছিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে কয়েক মিনিট হয়ে গেল, ট্রেন নড়ে না। পাশের ডাউন লাইন দিয়ে ঝম ঝম করে বেরিয়ে গেল তিনটি ট্রেন। এ বার একটু ঘাবড়ে গেলাম। কোনও ঘোষণা নেই। কী হয়েছে, তা-ও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মোটরম্যানদের তরফেও কোনও ঘোষণা নেই। কেবল মাঝে মাঝে স্পিকারে শোনা যাচ্ছে, ‘প্লিজ ওয়েট’।

Advertisement

১১টা ৩০ মিনিট

একটা পোড়া গন্ধ। আর তাতেই বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল। পাশের যাত্রীটি ইঞ্জিনিয়ার। বললেন, চাকার সঙ্গে লাইনের জোর ঘর্ষণে ওই রকম গন্ধ হয়। এতে ভয়ের কিছু নেই। গন্ধটা অবশ্য চলে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ডাউন লাইনে আরেকটি ট্রেন গেল। সুড়ঙ্গের মধ্যে ট্রেনের ভিতরে কুড়ি মিনিট হয়ে গেল। চাঁদনি চকে নামি। পিছনের দিকে থাকলে সুবিধা হয়। তাই শেষ কামরায় ছিলাম। পিছনের মোটরম্যান টিং টিং করে আওয়াজ দিচ্ছেন সামনের মোটরম্যানকে। কিন্তু ও দিকে সাড়া নেই।

১১টা ৪৫ মিনিট

ট্রেনের ভিতরে আলো নিভে গেল, পাখাও বন্ধ হয়ে গেল। সুড়ঙ্গের মধ্যে হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা নেই। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। একটি শিশু কেঁদে উঠল। বন্ধ ট্রেনের মধ্যে আমরা কুল কুল করে ঘামছি। তবুও ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম, ‘ভাগ্যিস এসি রেক নয়! এসি রেক হলে জানালাও বন্ধ থাকত! তা হলে কী যে হত!’ তবে ট্রেনের যাত্রীদের ধন্যবাদ দিতে হয়। কোনও ঘোষণা নেই, আলো নেই, পাখা বন্ধ, টিম টিম করে জ্বলছে ইমার্জেন্সি লাইট তা-ও অধৈর্য হননি তাঁরা। বরং এক-আধ জন উত্তেজিত হয়ে উঠলে অন্যেরা তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন। বলছেন, ‘একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই, দেখবেন। হয়তো সামনের মোটরম্যানের কেবিন দিয়ে আমাদের নামানোর ব্যবস্থা হবে। শুধু শুধু চেঁচামেচি করে অন্যদের টেনশন বাড়িয়ে কী লাভ!’

১১টা ৫৫ মিনিট

নজর গেল কামরায় দরজার উপরে মেট্রোর হেল্পলাইন নম্বরগুলির দিকে। ইমার্জেন্সি আলোতেও পড়া যাচ্ছিল। কিন্তু তাতেই বা কী? সুড়ঙ্গের মধ্যে মোবাইলে টাওয়ার মেলে না। ফোন করব কী করে? এর মধ্যে কিছু স্কুলের বাচ্চা চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তাদের মায়েরা ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চোখা চোখা বিশেষণ ভেসে আসছে। আমার জামাটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছে। রুমাল ভিজে গিয়েছে, আর ঘাম মোছা যাচ্ছে না। এক যাত্রীর জলের বোতল নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল।

১২টা ৫ মিনিট

একে প্রচণ্ড গরম, তার উপরে হাওয়া নেই। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। যাঁরা বিএসএনএল ব্যবহার করেন, তাঁদের কয়েক জনের মোবাইল দেখলাম কাজ করছে। এক বৃদ্ধ বাড়িতে ফোন করে বলছেন, ‘অন্ধকার, হাওয়া নেই, জানি না কী ভাবে এই অন্ধকূপ থেকে বের হব। খাওয়ার জলও পাচ্ছি না। মেট্রোর কেউ এখনও সাহায্য করতে আসেনি।’ তারই মধ্যে অতি উৎসাহী কয়েক জন আবার মোবাইলে পটাপট ছবি তুলছেন। নিজের বান্ধবীকে নিয়ে পোজ দিয়ে এক তরুণ ছবি তুলতে তুলতে বললেন, ‘এটা তো একটা লাইফটাইম অভিজ্ঞতা। ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে তো!’

১২টা ১৫ মিনিট

উল্টো দিকে যাওয়ার ট্রেনও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অধের্য হয়ে পড়া এক মহিলাকে তাঁর পুরুষ সহযাত্রীর সান্ত্বনা, ‘থার্ড লাউনে পাওয়ার অফ করে দিয়েছে। এ বার নিশ্চয়ই আমাদের নামানোর ব্যবস্থা হবে।’ দেখলাম পিছনের মোটরম্যান দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। বোঝা গেল সামনের মোটরম্যানের কেবিন দিয়ে আমাদের অর্থাৎ আটকে থাকা যাত্রীদের নামানোর ব্যবস্থা হবে।

১২টা ২৫ মিনিট

অন্ধকার সুড়ঙ্গে আটকে পড়ার পরে অন্তত এক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এমন সময় ঘোষণা, ‘আপনারা সবাই সামনের দিকে এগিয়ে আসুন। সেখান দিয়ে আপনাদের নীচে নামিয়ে আনা হবে।’

আমরা একেবারে পিছনের কামরায়। আমাদের সামনে আরও সাতটা কামরা। অর্থাৎ, সেই যাত্রীরা নামার পরে আমাদের কামরার লোকেরা বেরোতে পারবেন। এই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা রাখলেন যাত্রীরা। নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক হল, মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের আগে যেতে দেওয়া হবে।

সেই মতো সব পুরুষ যাত্রী জায়গা করে দিলেন। বাচ্চা কোলে মহিলা, লাঠি হাতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যেতে দেওয়া হল আগে। আর তার পরের কামরায় আর্জি গেল, ‘দাদা, ওঁদের একটু আগে যেতে দিন।’

১২টা ৩৫ মিনিট

আমরা আটকে আছি শেষ কামরাতেই। সামনে এগিয়ে ভিড় বাড়িয়ে লাভ নেই। লাইন এগোচ্ছে অতি ধীরে। ভিড়ের মধ্য থেকেই টিপ্পনি, ‘খারাপ রেক কেনই বা বের করল মেট্রো?’ ‘ভাড়া বাড়ে, কিন্তু যাত্রীদের কথা কেউ ভাবে না,’ ‘এত দিন মেট্রো চড়ছি, এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি,’ ‘এ বার মেট্রো তুলে দেওয়াই উচিত’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

১২টা ৪৫ মিনিট

অনেকটা সামনের দিকে এগিয়ে এসেছি। ট্রেনের বেশির ভাগ যাত্রীই নেমে গিয়েছেন। আমরা জনা কয়েক এখনও আছি। আমার হাত ধরে আছেন এক বৃদ্ধ। তাঁর হাত কাঁপছে। নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। অভয় দিলাম, ‘মেসোমশাই, ওই দেখুন বাইরে লোকজন। আমরা এসে পড়েছি।’

১২টা ৫০ মিনিট

মোটরম্যানের কেবিনে পৌঁছলাম। কেবিনের সামনে (বাঁ দিক চেপে) একটি অংশ খুলে ফেলা হয়েছে। সেখানে লেগেছে তিন ধাপের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নামলাম নীচে। আমার হাত তখনও ধরে আছেন ওই বৃদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রেল লাইনের পাশের অপরিসর জায়গা দিয়ে জল কাদা এড়িয়ে প্রায় একশো মিটার হেঁটে অবশেষে উঠলাম পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মে।

বৃদ্ধ আমার হাত ছেড়ে বাড়িতে ফোন করলেন, ‘বেঁচে গেছি।’ ফোন রেখে হাত জোড় করে উপরওয়ালার উদ্দেশে প্রণাম করলেন। আমি তখন অনেকটা এগিয়ে এসেছি।

১২টা ৫৫ মিনিট

সিঁড়ি দিয়ে উঠে মেট্রো স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এত ক্ষণ বাদে যেন বুক ভরে শ্বাস নিলাম।

দেখলাম টিভি ক্যামেরাম্যান আর খবরের কাগজের ফটোগ্রাফারদের ভিড়। স্টেশনের বাইরের সিঁড়িতে শুয়ে রয়েছেন এক তরুণী। তাঁর চোখেমুখে জল ছেটাচ্ছে ছোট্ট একটা ভিড়। তরুণী না কি ওই ট্রেনেরই যাত্রী ছিলেন, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ মনে হল, যে মহিলাকে সবার আগে জায়গা করে দিয়েছিলাম, তিনি আর তাঁর কোলের শিশুটি সুস্থ তো?

মোবাইলে টাওয়ার ফিরে এল। টিং টিং করে বেজেই চলেছে। দেখলাম অন্তত ১৫টা মিস্ড কল। সহকর্মীরা ফোন করে এত ক্ষণ আমাকে পাচ্ছিলেন না। এ বার তাঁরা জানলেন, এ দিনের মেট্রো-বিভ্রাটে ভুক্তভোগীদের এক জন এই শর্মা। উপরে উঠে ফের বিপদ। যানজট। গাড়ি নড়ছে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement