ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে ক্যানসারের পরেও মা

একই ভাবে দুশ্চিন্তা করছিলেন বছর আঠাশের পৌষালী রায়ও। বেশ কিছু দিন অসুস্থতা চলার পরে চিকিৎসক সবে জানিয়েছেন, জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত পৌষালী।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৪৭
Share:

সন্তানের চেষ্টায় চিকিৎসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা জলাঞ্জলি দিতে হয় বলে অভিযোগ অনেকেরই।

দিন কয়েক ধরে স্তনে একটি মাংস পিণ্ড অনুভব করছিলেন বছর তিরিশের স্নেহা মজুমদার (নাম পরিবর্তিত)। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। অস্ত্রোপচারের পরে নিতে হবে কেমোথেরাপিও। এর পর থেকে নানা আশঙ্কা ঘুরপাক খেতে শুরু করে সদ্য বিবাহিতা ওই তরুণীর মনে। ক্যানসার চিকিৎসার পরে নিজে সুস্থ হলেও সন্তানধারণ করা সম্ভব হবে কি তাঁর পক্ষে? কেমোথেরাপির পরে কি ডিম্বাণুর মান একই থাকে?

Advertisement

একই ভাবে দুশ্চিন্তা করছিলেন বছর আঠাশের পৌষালী রায়ও। বেশ কিছু দিন অসুস্থতা চলার পরে চিকিৎসক সবে জানিয়েছেন, জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত পৌষালী। অসুখের প্রথম ধাপে থাকলেও দ্রুত তাঁর চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) পরিসংখ্যান বলছে, স্তন এবং জরায়ুর ক্যানসারে অক্রান্তদের মধ্যে স্নেহা কিংবা পৌষালীর মতো অল্প বয়সী তরুণীর সংখ্যা যথেষ্টই বেড়েছে। ভারতে ফি বছরই একটু একটু করে বাড়ছে স্তন ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা। ২০১৬ সালে এ দেশে মোট ক্যানসার আক্রান্তের ১০ শতাংশ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এখন সেই সংখ্যা অনেক বেশি।

Advertisement

আরও পড়ুন: মশারিতে বসে রং-তুলি, ডেঙ্গি প্রতিরোধের বার্তা দিল খুদেরা

তবে তাতেই থেমে যাচ্ছে না জীবন। তরুণ প্রজন্মের ক্যানসার আক্রান্তদের অধিকাংশ সুস্থ হয়ে ওঠার পরে সন্তানধারণও করছেন। কোনও অসুবিধেই যে হচ্ছে না তেমন নয়, কিন্তু উপায়ও আছে। বিভিন্ন আইভিএফ সেন্টারে করা হয় ডিম্বাণু সংরক্ষণ। সেখানে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে লিকুই়ড নাইট্রোজেনে ডিম্বাণু রাখা হয়।

কলকাতার একটি বেসরকারি বন্ধত্ব চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসক রোহিত গুটগুটিয়া বলেন, ‘‘আধুনিক জীবনযাপন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। স্তন কিংবা ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের জেরে অনেক সময়ে ডিম্বাণুর গুণমান কমে যায়। কারণ, কেমোথেরাপির পরে ডিম্বাণুর উৎপাদন কম হয়। চিকিৎসার পরে সন্তানধারণে যেন কোনও সমস্যা না হয়, তার জন্য অনেকেই এখন বেছে নিচ্ছেন ডিম্বাণু সংরক্ষণের পথ।’’

চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপি করালে শুধু ক্যানসার আক্রান্ত কোষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় অস্থিমজ্জা, চুল কিংবা ডিম্বাণুর মতো বিভিন্ন ‘গ্রোইং সেল’। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেমোথেরাপির পরে ডিম্বাণু তৈরির পরিমাণ কমে যায়। তাই চিকিৎসা শুরুর আগে যদি ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা যায়, তা হলে চিকিৎসা পরবর্তীকালে সন্তানধারণে কোনও সমস্যা থাকে না। বিশেষত যে সব মহিলা তিরিশের পরে স্তন কিংবা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের সন্তানধারণের পরিকল্পনা থাকলে চিকিৎসা শুরুর আগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা।

এইমসের শল্য চিকিৎসক ধৃতিমান মৈত্র বলেন, ‘‘এখন অনেক কম বয়সীদের মধ্যেও স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যানসারের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অস্ত্রোপচারে ডিম্বাণুতে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু অস্ত্রোপচার পরবর্তী যে সব থেরাপি করা হয়, তার জেরে অনেক সময়েই ডিম্বাণু উৎপাদন কমে যায়। তাই সেই থেরাপির আগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করা ভাল।’’

স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘স্তন ক্যানসারের থেকেও ডিম্বাশয় কিংবা জরায়ুর ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ডিম্বাণুর মান কমিয়ে দেয়। নিম্নমানের ডিম্বাণু হলে সন্তানধারণ সম্ভব নয়। গর্ভপাতের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই ক্যানসার চিকিৎসা শুরুর আগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করলে এ ধরনের ঝুঁকি এড়ানো যায়।’’ তবে নিম্নমানের ডিম্বাণুর জেরে অসুস্থ সন্তানের জন্ম হয় না। এটা ভ্রান্ত ধারণা বলেই মত মল্লিনাথবাবুর।

এসএসকেএম হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসক সুভাষচন্দ্র বিশ্বাসের কথায়, ‘‘অস্ত্রোপচারের আগে ডিম্বাণু সংরক্ষণ না হলেও কেমোথেরাপির আগে সংরক্ষণ করা জরুরি। বিদেশে ডিম্বাণু সংরক্ষণের প্রচলন বহু দিন ছিল। কিন্তু এ দেশে এ বিষয়গুলি নিয়ে নানা সংস্কার ছিল। তবে সেগুলি এখন কাটছে। এ দেশেও মেয়েরা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করছে।’’

বিশেষজ্ঞদের একাংশের অবশ্য পরামর্শ, ২০-২২ বছর বয়সী কেউ এ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হলে কিছুটা অপেক্ষা করা দরকার। কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপির বছর দুয়েক পরে রোগীর ডিম্বাণু উৎপাদনের হার বোঝা যায়। যেহেতু তিরিশের কম বয়সীদের মধ্যে ডিম্বাণু উৎপাদনের ক্ষমতা বেশি থাকে, তাই কেমোথেরাপির কিছু দিন পরে শরীর আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে পারে। য়ে কোনও পদক্ষেপ করার আগে তা দেখে নেওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন অধিকাংশ চিকিৎসক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন