কলকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ হায়দর মঞ্জিলের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হল কেন্দ্রীয় সরকার। আহমেদাবাদের ‘সবরমতী আশ্রম প্রিজার্ভেশন অ্যান্ড মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন বেলেঘাটার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। একসময়ে গাঁধীজীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ভবন।
১৯৪৬-এর ১৬ অগাস্ট মুস্লিম লিগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ পরিকল্পনার জেরে কলকাতায় শুরু হল ব্যাপক অশান্তি। অক্টোবরে নোয়াখালি, ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়ল তার আঁচ। ৫ নভেম্বর রাজেন্দ্রপ্রসাদ পটনায় ঘোষণা করলেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবস্থা শান্ত না হলে অনশন শুরু করবেন মহাত্মা গাঁধী। সাময়িক সুরাহা হলেও ধিকিধিকি আগুণ ছিলই। মুস্কিল আসানের পথ খুঁজতে ১৯৪৭-এর ৪ মার্চ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি গাঁধীজীর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। ১২ অগাস্ট গাঁধীজী এলেন বেলেঘাটার এই ভবনে। পরদিন ক্ষুব্ধ একদল হিন্দু এখানে এসে নিরাপত্তার অভাব জানিয়ে বিক্ষোভ দেখালেন অসহায় গাঁধীজীর সামনে। শহর জুড়ে তখন তুলকালাম কান্ড চলছে। পরিস্থিতি শান্ত করার দাবিতে ১ সেপ্টেম্বর থেকে অনশন শুরু করলেন গাঁধীজী। প্রফুল্ল ঘোষ, হেম নস্কর, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের অনুরোধে ৭৩ ঘন্টা বাদে অনশন প্রত্যাহার করেন। ৬ সেপ্টেম্বর গাঁধীজী চলে গেলেন দিল্লি।
শান্তিপ্রক্রিয়ায় গাঁধীজীকে এখানে নাকি নিয়ে আসেন সুরাবর্দি। গাঁধীজীর নানা ছবি, তথ্য ও স্মারক নিয়ে পরবর্তীর্কালে এখানে তৈরি হয় ছোট সংগ্রহশালা। দেখভালের জন্য ২০১৩-র সেপ্টেম্বর মাসে সমবায়-ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘পূর্ব কলকাতা বাপুজি স্মারক সেবা সমিতি’। এখন পর্যন্ত ৫৬ জন সদস্য। চাঁদা গোড়ায় ৫০ টাকা, মাসে ৫ টাকা। এককালীন ১ হাজার টাকা দিলে আজীবন সদস্য। এখন এই সুন্দর বাড়িটিতে হয়েছে একটি সংগ্রহশালা।
মূল হলঘরে একটি বড় বেদি। ওখানে বসে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলতেন গাঁধীজী। দেওয়ালে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিনলিপি। ডান পাশে তিনটি ঘরে আছে কলকাতা, নোয়াখালি-সহ বিভিন্ন উপদ্রুত স্থানে গাঁধীজীর ছবি, বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত গাঁধী-সম্পর্কিত সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনার প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিলিপি। আছে গাঁধীজীর বিছানা-বালিশ-পাশবালিশ, ট্যাঁকঘড়ি, লাঠি-মালা-খড়ম, চটি।
কেন বাড়িটির নাম ‘হায়দর মঞ্জিল’? সমিতির এক সদস্য বলেন, এককালে এই বাড়ি এবং সংলগ্ন জমির মালিক ছিলেন নবাব হায়দার আলি। তিনি এটি কন্যা হুসনি বাঈকে উপহার দেন। প্রায় ছেলেবেলা থেকে এই বাড়ির সঙ্গে যুক্ত দিলিপ দে। তিনি বলেন, ‘‘হলঘরটি ছিল হুসনি বাঈয়ের নাচঘর। আগে রাতে নাকি ওখান থেকে আসত ঘুঙুরের শব্দ।’’ হুসনি দীর্ঘমেয়াদি লিজে এটি হস্তান্তর করেন। লিজপ্রাপ্ত পরিবারের এক ব্যক্তি নাকি ‘গাঁধী ময়দান’ নামে পাশের মাঠটির মালিকানা গচ্ছিত রেখে কয়েক বছর আগে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্ক থেকে মোটা টাকা ঋণ নেন। অনাদায়ী ঋণ আদায় করতে না পেরে ব্যাঙ্ক জমিটি নিয়ে নেয়। এক নির্মাতা সংস্থার হাতে যায় জমি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধায় ওই সংস্থা জমির দখল নিতে পারেনি।
এখন গাঁধীজীর জন্ম ও মৃত্যুদিন ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি প্রমুখ কিছু মণীষীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সমাবেশ হয়। বছরের বিশেষ ক’দিন তোলা হয় জাতীয় পতাকা। ‘পূর্ব কলকাতা বাপুজি স্মারক সেবা সমিতি’-র সহ সম্পাদক কানাইলাল কুন্ডু বলেন, ‘‘ঐতিহ্যের এই ভবন ও সংলগ্ন জমিটি রক্ষা করার ব্যাপারে আমরা সমস্যায় পড়েছি। রয়েছে আর্থিক সঙ্কটও। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে এ সব জানিয়েছি। দেখা যাক।" ক্ষোভের সঙ্গে কানাইবাবু বলেন, আমাদের মত অর্থাভাবে জর্জরিত আবানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছেও জলের সংযোগের জন্য পুরসভা কর চাইছে। অনেক দৌড়োদৌড়ি করেও মকুব করাতে পারছি না।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ‘গাঁধী হেরিটেজ সাইট মিশনের’ সচিব শ্রেয়া গুহ চিঠি পাঠান বেলেঘাটার এই প্রতিষ্ঠানে। তাতে জানান, দেশের বিভিন্ন গাঁধীর স্মৃতি জড়িত ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করবে আহমেদাবাদের ‘সবরমতী আশ্রম প্রিজার্ভেশন অ্যান্ড মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। পরিকল্পনাটা কীরকম? সেখানকার পদস্থ এক অফিসার বলেন, “গোটা দেশে গাঁধীজীর সঙ্গে গভীরভাবে সংপৃক্ত কিছু কেন্দ্র নির্বাচিত করা হয়েছে। এ সব কেন্দ্রের ঠিক কোন অংশে গাঁধীজী কী করতেন, সেখানকার সঠিক বর্তমান হাল, সমসাময়িক পরিমন্ডল তৈরির কতটা বা কী রকম অবকাশ রয়েছে, সেখানকার পুরনো আবহ সম্পর্কে অভিজ্ঞদের মতামত প্রভৃতি নির্দিষ্ট কিছু জিনিস জানা দরকার। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ স্থপতি নিয়োগ করা হয়েছে। বেলেঘাটার আশ্রমটিও এই তালিকায় আছে।”