মনোযোগ: মেটিয়াবুরুজে পোশাক তৈরির কাজে ব্যস্ত কিশোরেরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
একটানা ঘড়ঘড় শব্দ শুনে নিচু দরজাটার সামনে যেতেই আটকে গেল পা। দরজার ও দিকে রাশি রাশি লাল, হলুদ, গোলাপি নেট কাপড়ের টুকরো। চারটি মেশিনে ঘাড় গুঁজে সে সব জোড়া লাগাচ্ছে আজিজুল, জামির, আনোয়ার আর হামিরুল। অ্যাসবেস্টসের ছাদের উত্তাপের কাছে তখন প্রায় বিশ গোলে পর্যুদস্ত মেটিয়াবুরুজের ঘিঞ্জি গলির বুড়ো পাখাটা। ঘামে জবজবে চার কিশোর তবুও মগ্ন।
লক্ষ্মীকান্তপুরের চার কিশোরের কারও এ তল্লাটে দু’মাস তো কারও বছর ঘুরেছে। প্রশিক্ষণে থাকা এই ‛আবাসিক’দের মাস মাইনে মেরেকেটে দেড় থেকে দু’হাজার। কারও ঘরে প্রতীক্ষায় সাতটি মুখ, কারও আবার পাঁচটি। বাড়ির জন্য মন কেমন করে? উত্তর— না। আজিজুল ও জামির জানাল, ঘাম ঝরানো টাকা বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়াতেই ওদের আনন্দ। “ঠান্ডা ঘরে বসে ভাববেন, ওরা শিশু শ্রমিক। আসলে ছোট থেকে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাঁচার লড়াই শিখছে। এ ছাড়া ওদের উপায় কি বলুন তো!”― বললেন এক বৃদ্ধ।
পাঁচ সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে রবিউন্নেসার পুরো পরিবার ডুবে এই কাজে। পুজো আর দিওয়ালির মরসুমেই ওদের যত রোজগার। মেয়েদের বিয়ের জন্য গয়না গড়ানো, সাজের জিনিস কেনা কিংবা ঘন ঘন গোস্ত রান্না― সবই চলে এই উৎসব ঘিরে। ইদের আগেও ভাল কাজ আসে, তবে এই সময়টায় বেশি, জানালেন সুন্দরী খাতুন। ঘরের কাজের ফাঁকেই তৈরি জামায় বোতম লাগিয়ে আর নকশা করে দিদি নয়নতারা মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা আয় করেন। অন্য সময় অবশ্য এর অর্ধেক আয় হয়। এ কাজে আছেন ওঁদের বাবা ও দুই ভাই।
এই মরিয়া লড়াইটাই সম্ভবত বিস্তৃত করছে কলকাতার সব থেকে বড় পোশাক কারখানা মেটিয়াবুরুজের পরিধিকে। বিশ বছর আগে মেটিয়াবুরুজেই থাকতেন কারিগরেরা। জায়গার সঙ্কুলান সেই ছবির পরিবর্তন এনেছে। এখন কাপড় কাটার পরে তা ডায়মন্ড হারবার, বাগনান, বসিরহাট, ক্যানিং, বনগাঁর কারিগরদের কাছে চলে যায়। পরিবারের সকলে মিলে কাজ করেন তাঁরা। সপ্তাহের শেষ কাজের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার সেলাই করা কাপড় দিয়ে যান মেটিয়াবুরুজে।
দোকানের শোকেসে সাজানো একটা পোশাকের পিছনে থাকে দশ জনের পরিশ্রম। ওস্তাগরের তত্ত্বাবধানে চলে সবটা। এক জন ওস্তাগর মানে একটা কোম্পানি। কাপড় কেনা, নকশা বানানো, প্যাটার্ন তৈরি, কাপড় কাটা, সেলাই, তাতে বোতাম ও নকশার কাজ, ফিনিশিংয়ের কাজ, ইস্ত্রি করা, বাক্সবন্দি করা, বিক্রির জন্য তা হাটে বা দোকানে পাঠানো। এই কর্মযজ্ঞে ঢিলেমি এলেই ব্যবসায় মার খেতে হবে। ‘‘আপনাদের পঞ্জিকা মুখস্থ রাখি আমরা। কারণ সেই হিসেবেই ব্যবসা করতে হবে। প্রতিমার গায়ে রং ওঠার আগে বাজারে নতুন নকশার পোশাক হাজির করাতে হয়। কারণ ওই সময়েই জমে ওঠে বিক্রি।’’― তুমুল ব্যস্ততার ফাঁকে বললেন ওস্তাগর আবুল বাশার। স্থানীয়দের কাছে হাজি সাহেব নামে পরিচিত তিনি। ঠাকুর্দার আমলের ব্যবসায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল তাঁর।
“আপনাদের লক্ষ্মীবারেই মেটিয়াবুরুজের বস্ত্রপট্টিতে সপ্তাহের শুরু। শনি আর রবিবার মেটিয়াবুরুজে জব্বার হাট-সহ প্রায় ছ’-সাতটি হাট বসে। ভোর থেকে রাত ৮টা-৯টা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা।” বললেন ওস্তাগর বাইতুল আলম লস্কর। হাটের হাজার বিশেক খুপড়ি স্টলে তৈরি জামার একটা করে নমুনা নিয়ে বসেন এক জন। ব্যবসায়ীদের পছন্দ হলে খবর চলে যায় গুদামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এই হাটে আসেন।
তবে ওস্তাগরের অধীন প্যাটার্ন মাস্টারের কদর অন্যদের তুলনায় বেশি। দশ বছর ধরে এই পেশায় আছেন মুন্সি নাসিম। বছরে পঁচিশ হাজার টাকায় ঘর ভাড়া করে থাকেন। তিন ভাই মিলে একসঙ্গে একাধিক কোম্পানির (ওস্তাগর) কাজ করেন ওঁরা। সাইজ প্রতি রেট একশো টাকা।
নমাজ পড়তে যাওয়ার আগে টুপি ঠিক করতে করতে হাজি সাহেব বললেন, “কারা যেন বলেন, ওঁরা হিন্দু, ওঁরা মুসলমান! দেওয়ালি মিটলে আসুন, ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব কেমন নিস্তব্ধতা। কুমোরটুলির মতো। আমাদের সারা বছরের মূল রোজগারটা তো এই উৎসব ঘিরেই। বিসর্জনের পরে তাই মনটা খারাপ থাকে। এ ভেবেই বোধহয় আমাদের সঙ্গে শ্যামলদা আর তপনদারা এক সুতোয় বাঁধা পড়েছেন।”