উৎসব কাপ শুরু হতে আর দু’দিন বাকি। কিন্তু শহরের অলিগলিতে এখনই বেজে উঠেছে পুজোর বাদ্যি! আজ, শনিবার থেকে খুলে যাবে বহু পুজোরই মণ্ডপ।
উৎসব কাপ শুরু হয়েছে নগরবাসীরও। কেনাকাটা শেষ। শুধু রাস্তায় নামার অপেক্ষা। পুজোকর্তাদের ধারণা, এ দিন বিকেল থেকেই পথে নামবে শহর। পঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হবে উৎসব কাপ। লালবাজারেরও তেমনটাই ধারণা। পঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই রাস্তায় নামবে কলকাতা পুলিশও।
অনেকেই বলছেন, শহরের অলিগলিতে প্রায় আড়াই হাজার পুজো হয়। কিন্তু ইনিংসের গোড়া থেকেই বড় পুজোর দিকে ভিড় বাড়বে। পুজোকর্তারা বলছেন, উৎসবের দিন যত গড়াবে, ততই ভিড় জমবে নামী পুজোর মণ্ডপে। তুলনামূলক ফাঁকায় ঠাকুর দেখতে তাই আগেভাগেই বড় পুজোর মণ্ডপে ঢুঁ মারতে চান লোকজন।
উত্তরের কথা যদি ধরা হয়, ষষ্ঠী হোক বা নবমী বাগবাজার সর্বজনীনের মণ্ডপে পা দেন না এমন লোক বোধহয় নেহাতই হাতেগোনা। একই কথা খাটে সিমলা ব্যায়াম সমিতির ক্ষেত্রেও। আবার দক্ষিণ বললেই সাবেক পুজোর আর আড্ডায় জনপ্রিয় ম্যাডক্স স্কোয়ার। পুজোকর্তারা বলছেন, থিম বাজারে সাবেকিয়ানাই ব্র্যান্ড ভ্যালু হয়ে উঠেছে এই পুজোগুলির।
কোনও কোনও পুজো আবার শহরের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মণ্ডপ যেমনই হোক না কেন, কলেজ স্কোয়ার, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার কিংবা মহম্মদ আলি পার্কে ভিড় হবে না, এমনটাও ভাবা দুষ্কর। ভিড় টানে ভিআইপি রোডের ধারে শ্রীভূমি স্পোর্টিংও। সেখানে এ বার সাবেক প্রতিমার ঝলমলে হিরের সাজ দেখতে লাইনটা আরও বড় হবে বলেই ধারণা পুজোকর্তাদের। দক্ষিণের পুজো দেখতে যাওয়া ভিড় আবার একডালিয়া, সিংহি পার্ক হয়ে মুদিয়ালি, শিবমন্দিরে ঢুকবেই। তবে শুধু অভ্যাসই নয়, এই পুজোগুলি ফি বছর চমকও দেয়। একডালিয়ায় এ বার যেমন প্রতিমার গা ভরা সোনার গয়না থাকছে। সিংহি পার্ক তুলে এনেছেন গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরকে।
শিবমন্দির অবশ্য থিমের পুজোতেই নাম করেছে। বাংলার পুরনো বাণিজ্যের ইতিহাস তুলে ধরছে তারা। “মণ্ডপ চত্বরেও ব্যবসা থাকবে। আমাদের থিম সং গেয়েছেন লোপামুদ্রা মিত্র। সেই সিডি পুজোর সময়ে বিক্রি হবে,” বলছেন শিবমন্দিরের পুজোকর্তা পার্থ ঘোষ। তাদের প্রতিবেশী মুদিয়ালি ফুটিয়ে তুলছে পরিবেশ দূষণে বিপন্ন জীবকূলকে। সংরক্ষণের বার্তা দিতে থাকবে কৃত্রিম পাখি-প্রজাপতির ঝাঁক।
অভ্যাস হোক বা সাবেকিয়ানা, কলকাতার পুজো ময়দানে থিমের দাপটও কম নয়। কেউ চমক দেয় উপকরণে, কেউ ভাবনায়। কোথাও পুজোকর্তা আবার থিমের চমক দেখাতে উদ্বোধনের আগে পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। গত বছর পনেরো ধরে কলকাতাকে থিমের চমক দেখিয়েছে নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ। কখনও বাংলা, কখনও গোয়া নানা রাজ্যকে তুলে এনেছে তারা। শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে এ বারে ছত্তীসগঢ় উঠে আসছে সুরুচিতে। লাইনটাও বাড়বে বলেই মনে করছেন সুরুচির কর্তারা। থিম পুজোর রমরমাতেই যাদের ভাল করে চিনেছিল শহর, সেই কসবা বোস পুকুরে এ বার মণ্ডপ সাজছে তিন লক্ষের বেশি বিস্কুট আর ৫০০০ ক্যান্ডি দিয়ে। সাজের দায়িত্ব নিয়েছেন শিল্পী দেবেশ মুখোপাধ্যায়।
গত কয়েক বছরে পুজো বাজারে উঠে এসেছে নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘও। শিল্পী ভবতোষ সুতারের হাত ধরে পিতল ও মেহগনি কাঠের প্রতিমা দেখিয়েছিল এই পুজোই। এ বারে ভবতোষই সেখানে দেখাবেন সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের ছন্দ। উত্তরের নামী পুজো আহিরীটোলা সর্বজনীনেও ভবতোষ তুলে ধরেছেন সময়কে। প্রতি বছরের মতো এ বারেও সেখানে লম্বা লাইন পড়বে বলেই মনে করছেন পুজোকর্তা দুলাল সিংহ।
দক্ষিণের ভিড়ের মুখ থাকে হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনেও। ছোট জায়গাতেও যে বড় পুজো করা যায়, তা এই পুজোকর্তারা দেখিয়েছেন। এ বার শিল্পী প্রশান্ত পাল শাখা, সিঁদুর, লালপেড়ে শাড়িতে ভক্তিভাবের থিম গড়ে তুলছেন। হিন্দুস্থান পার্ককে টক্কর দিতে তৈরি ত্রিধারা সম্মিলনীও। গত কয়েক বছরে শহরের নামী শিল্পীদের হাত ধরে প্রথম সারিতে উঠে এসেছে তারাও। এ বার তাদের মণ্ডপ সাজছে তিব্বতের মুখোশ এবং নানা জিনিস দিয়ে। প্রতিমাও হচ্ছে স্থানীয় দেবদেবীর আদলে। গত কয়েক বছরে প্রথম সারিতে উঠে এসেছে সুরুচির প্রতিবেশী চেতলা অগ্রণীও। এ বার তাদের পুজো সাজানোর ভার এক সময়ে ‘উত্তরের ঘরের ছেলে’ সনাতন দিন্দার উপরে। হাওয়ায় ভাসমান মূর্তি গড়ে লোক টানতে তৈরি চেতলাও। দক্ষিণ শহরতলির পুজোয় নামী পুজো হরিদেবপুর অজেয় সংহতিও। পিলসুজের মতো মণ্ডপ। থাকছে কাঠ-মাটির প্রদীপের কারুকার্যও।
পুজোয় যদি থ্রি-ডি শিল্পের কারসাজি দেখতে যোধপুর পার্কে যেতেই হবে। ওই এলাকায় পুজোয় ভিড় টানে সেলিমপুর পল্লিও। বহু বছর আগে পুজোয় ভিন্ রাজ্যের শিল্পী এনে তাক লাগিয়েছিল তারা। এ বার সেলিমপুরে নতুন শিল্পী শুভদীপ মজুমদার সেখানে রাজস্থানী মিনেকারি কাজের সঙ্গে লোকশিল্পকে মিশিয়ে নতুন শিল্প ফুটিয়ে তুলছেন।
বছর কয়েক ধরে ভিড় টানার লড়াইয়ে নাম করেছে দমদম পার্কের তরুণ সঙ্ঘ আর ভারতচক্রও। শিল্পী প্রশান্ত পালের হাতে সেজে উঠছে তরুণ সঙ্ঘের মণ্ডপ। হরিয়ানার উৎসব ফুটিয়ে তোলা হবে সেখানে। পাশের পুজো ভারতচক্রে আবার ঘটছে প্রযুক্তির সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধই থিম। স্টেনলেস স্টিলে নানা ধরনের আলোর প্রতিফলন তৈরি করবে ‘ইলিউশন এফেক্ট’।
সাবেকিয়ানা ছেড়ে থিমের পুজোয় নাম করেছে, এমন উদাহরণও বিরল নয়। যেমন উত্তরের অন্যতম পুরনো পুজো হাতিবাগান সর্বজনীন। গত কয়েক বছরে থিম-পুজোয় হাত পাকিয়েছে তারা। গত বার বস্তারের মহিষের শিং দিয়ে শিল্পের কাজ করেছিল তারা। এ বার হাতিবাগান সর্বজনীনের বাজি ওড়িশার তালপাতায় খোদাই চিত্রকলা।
এক সময়ে সাবেকী পুজোর রমরমা ছিল হাতিবাগানের কাশী বোস লেনেও। কিন্তু সেই মোড়ক ছেড়ে থিম বাজারে ঢুকে পড়েছে তারাও। গত বছর কাশের বনে আলোছায়ার খেলা দেখিয়ে ভিড় টানার পরে এ বার রাজস্থানী মিনেকারি কাজের ধাঁচে প্রতিমা দেখতেও লোক উপচে পড়বে বলেই দাবি পুজোকর্তাদের।