শ্যামলী হালদার
পেঁয়াজের খোসা যত আলগা হচ্ছে, পরতে পরতে বেরিয়ে আসছে নতুন সব চমক আর নতুন কিছু মুখ! যা রহস্য এবং বিভ্রান্তিকে আরও জটিল করে তুলছে। নিউ আলিপুরের বৃদ্ধ মলয় মুখোপাধ্যায়কে কারা মারল, কেনই বা মারল, তা জানতে পুলিশের আপাতত দরকার খুনের আগের রাতের একটি নির্ভুল বিবরণ। আর ধোঁয়াশাও ঠিক সেখানেই।
রাতের আয়া কবিতা রায় মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, খুনের আগের দিন মলয়বাবু রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সয়াবিনের বড়ির তরকারি ও আনাজ সেদ্ধ খেয়েছিলেন। কিন্তু বুধবার ওই বাড়ির রাঁধুনি শ্যামলী হালদার দাবি করেছেন, তিনি সয়াবিন রান্নাই করেননি। ওলকচুর তরকারি ও শুক্তো রেঁধেছিলেন। মলয়বাবু শুক্তো ও তরকারি দিয়ে একটি রুটি খান। শ্যামলী জানিয়েছেন, সাড়ে ন’টা নাগাদ কবিতাকে খাবার বেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি। চেতলা লকগেটের কাছে একটি বস্তিতে থাকেন শ্যামলী।
এ ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে দু’টি বিষয়। প্রথমত, শ্যামলী আর কবিতার মধ্যে কে মিথ্যে বলছেন? দ্বিতীয়ত, রান্নার মতো সাধারণ বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলে লাভটাই বা কী?
শ্যামলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, ওই বাড়িতে তিনি ও কবিতা ছাড়া আরও এক জন পরিচারিকা রয়েছেন। তিনি দিনের আয়া পানু। অথচ, কবিতা যখন সেই রাতের বিবরণ দিয়েছিলেন, এক বারের জন্যও পানুর উল্লেখ করেননি। কিন্তু কেন? পুলিশের ধন্দ এখানেও।
শ্যামলী জানান, মলয়বাবুর পুত্রবধূ রাধাদেবীর মায়ের বাড়িতেও রাঁধুনির কাজ করেন তিনি। নিউ আলিপুরেই রাধাদেবীর মা ও ছোট বোন থাকেন। ২০০৬ সালে মাসিক দেড় হাজার টাকা বেতনে মলয়বাবুর বাড়িতে রান্নার কাজে যোগ দেন শ্যামলী। পরে তা বেড়ে তিন হাজার হয়। পুলিশের ধারণা, শ্যামলীর বয়ানে সত্যতা থাকলেও কবিতার কথায় নানা অসঙ্গতি রয়েছে। তদন্তকারীরা জানান, কবিতা, পানু ও শ্যামলী— এই তিন জন বহিরাগত ওই পরিবারের সব কিছুই জানেন। মলয়বাবুর খুনে পরিচিত কারও হাত যে রয়েছে, সে ব্যাপারে পুলিশ প্রায় নিশ্চিত। এ বার বয়ানের অসঙ্গতি দূর করতে দুই আয়া ও রাঁধুনিকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হবে।
রহস্য দানা বেঁধেছে আরও এক ব্যক্তিকে নিয়ে। তিনি কবিতার জামাই। পুলিশ তদন্তে জেনেছে, ওই যুবকেরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল মলয়বাবুর বাড়িতে। গত শনিবারও তিনি চেতলায় ছিলেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকে বেপাত্তা। সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে তাঁর হদিস মিলেছে। তদন্তকারীরা তাঁকেও জেরা করবেন। ঘটনাচক্রে মলয়বাবুর যে কম দামি দু’টি মোবাইল চুরি গিয়েছে, তার একটি সম্প্রতি কিছু ক্ষণের জন্য চালু করা হয়েছিল। ওই ফোনের টাওয়ার লোকেশনও ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
মলয়বাবুর অ্যাটাচি কেস নিয়েও ধোঁয়াশা। দুষ্কৃতীরা ঘরের একাধিক জিনিস ভাঙচুর করেছে। কিন্তু অ্যাটাচি ভাঙেনি। সেটি নিয়ে গিয়েছে। তা হলে কি সেটির খোঁজেই তিনটি ঘর লন্ডভন্ড করা হয়? সে ক্ষেত্রে মলয়বাবুর ঘুম ভেঙে যাওয়াতেই তাঁকে খুন করা হয় বলে অনুমান পুলিশের।
মাসখানেক ধরে মলয়বাবুর বাড়িতে যে কাঠের মিস্ত্রিরা কাজ করছেন, তাঁদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এঁদের কয়েক জন বিহারের বাসিন্দা।
পরিচারিকাদের বয়ানে অসঙ্গতি বা অ্যাটাচির গায়েব হওয়া— কোনও সূত্র ধরেই অবশ্য খুনের কিনারার দিকে এখনও বিশেষ এগোনো যায়নি বলেই জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। মলয় হত্যা-রহস্য তাই আরও ঘনীভূত হচ্ছে।