শিকড়ের টানে ফেরে হারানো মুখের সারি 

মাইক হাতে তাঁরা একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ পঞ্চাশ, কেউ সত্তরোর্ধ্ব।

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

ফাইল চিত্র।

মাইক হাতে তাঁরা একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ পঞ্চাশ, কেউ সত্তরোর্ধ্ব। মাইকে বলছেন নিজের নাম-পরিচয়, পুরনো পাড়ার নাম—যে ঠিকানা ছেড়ে এসেছেন বহুকাল আগেই। পরিচয় শুনে হলভর্তি অভ্যাগতদের কেউ নস্টালজিক, কেউ আবার ছুড়ে দিচ্ছেন প্রশ্ন— ‘বাবুপাড়ার অমুক কে হয়?’ অথবা ‘মাধ্যমিকের কোন ব্যাচ?’ আর এ ভাবেই ‘জলপাইগুড়ি সম্মিলনী’তে কেউ খুঁজে পাচ্ছেন দাদার বন্ধুকে, কেউ দেখা পাচ্ছেন শিক্ষিকার ভাইঝি অথবা হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীর।
যেমন, হরিদেবপুরের অধুনা বাসিন্দা গায়ত্রী সিদ্ধান্ত। জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার মজুমদার পরিবারের মেয়ে, বছর ষাটেকের গায়ত্রীদেবী উচ্চশিক্ষার জন্যে সেই যে পাড়া ছেড়েছিলেন, আর ফিরতে পারেননি। এখন তাই অপেক্ষা বছর শেষের সম্মিলনীর। গায়ত্রীদেবীর কথায়, ‘‘আমাদের বাড়ির কোণাকুণি বাড়িতে থাকতেন বুড়িপিসি ও পিসেমশাই। এ বার তাঁদের মেয়ের সঙ্গে দেখা হল, ঠিক সামনেই বসেছিল। কত দিন পরে দেখা!’’ ছোটবেলায় জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া দুই বান্ধবীকে রীতিমতো বগলদাবা করে এ বার দক্ষিণ কলকাতার ওই অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন গায়ত্রীদেবী। পরিচয় দিতে ইন্দ্রাণী-সুচিত্রাকে চিনতে পেরেছেন অনেক সহপাঠীই।
শিকড়ের সঙ্গে যোগসূত্র জিইয়ে রাখার এই আয়োজন অবশ্য শুরু হয়েছিল চার বন্ধুর জমায়েতকে কেন্দ্র করে। জলপাইগুড়ির আদি বাসিন্দা জয়শ্রী চৌধুরীর কথায়, ‘‘মনে হয়েছিল, এ শহরে জেলার যত লোক রয়েছেন, তাঁদের একসঙ্গে নিয়ে এলে কেমন হয়! সেই শুরু।’’ কখনও চেনা-পরিচিতদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে, কখনও ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের সাহায্যে ক্রমশ ছড়িয়েছে জমায়েতের খবর। কতটা সফল এই প্রয়াস? জয়শ্রীদেবী বলছেন, ‘‘মুম্বইয়ের এক শিল্পপতি এসেছিলেন। প্রথমে চিনতে পারিনি। কথা শুরু হতেই দেখি, তিনি আমাদের পাড়ার ছেলে ভোলা।’’
দেশভাগের আঁচড়ে পুরনো ঠিকানা হারিয়েছে যাঁদের, শিকড়কে মনে জিইয়ে রাখার ইচ্ছে তাঁদেরও কিছু কম নয়। তাই ‘দেশে’র জন্যে আজও বছরে অন্তত একদিন একত্রিত হন তাঁরা। নাটোর জেলার উদ্বাস্তুদের এ দেশে বাসস্থান খুঁজে দিতেই সত্তরের দশকে শুরু হয়েছিল ‘নাটোর সম্মিলনী’। এ বছর সেই অনুষ্ঠানের ৫০ বছর। সম্মিলনীর নিয়মিত সদস্য উমা সিদ্ধান্ত-প্রতিভানাথ সাহা জানাচ্ছেন, খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে আলাপ-কুশল বিনিময় আর নাটোরের স্মৃতিচারণাতেই কেটে যায় জমায়েতের অধিকাংশ সময়। সল্টলেকের বাসিন্দা, ৭৮ বছরের প্রতিভানাথবাবুর কথায়, ‘‘গত বছর নাটোরে থাকা এক বন্ধু অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ২০-৩০ বছর পরে দেখা। আমাদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো।’’
গোপালগঞ্জের উলপুর গ্রামের একদা বাসিন্দারাও এ দেশে চলে আসার পরে একই ভাবে শুরু হয়েছিল ‘উলপুর সম্মিলনী’। এখন কেউ সদ্য উলপুর ঘুরে এলে জমায়েতে তাঁর থেকেই সকলে জানতে চান, কেমন আছে তাঁদের ফেলে আসা গ্রাম-বাড়ি-উঠোন-দালান। শুধু দেখা
করাই নয়, উলপুরের পুরনো প্রতিবেশী-বন্ধুরা মিলে উতরে দেন দুর্গাপুজোও! যাদবপুরের বাসিন্দা রত্না গুহর কথায়, ‘‘এ দেশে আসার পরে সকলে বলত, আমাদের নিজেদের একটা পুজো হলে বেশ হয়। সেই থেকে গত ৬৫ বছর ধরে এই পুজো করছি।’’ কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উলপুরের পরিবারগুলি একসঙ্গেই কাটান পুজোর দিনগুলো। আর মাসে একবার কোনও সদস্যের বাড়িতে দেখা করেন ‘উলপুর মহিলা মহল’-এর সদস্যেরা। নাচে-গানে কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটিয়ে দেশভাগ আর দেশহারা হওয়ার দগদগে স্মৃতি ভুলতে চান তাঁরা।
তবে এমন অনুষ্ঠানে পরিচিতদের দেখা পেলেও কাছের লোকেদের কখনও ফিরে পাননি লেখিকা সুনন্দা শিকদার। মাত্র ১০ বছর বয়সে কাঁটাতার পেরিয়ে চলে আসা সুনন্দাদেবী বহু বছর পরেও মেনে নিতে পারেননি, তাঁকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা দাদার সঙ্গে তাঁর এই বিচ্ছেদ। এক বিয়েবাড়িতে
গিয়ে পেয়েছিলেন সেই দাদার মৃত্যুসংবাদ। ৪৮ বছর পরে ময়মনসিংহের গ্রামে ফিরে গিয়ে অনেক প্রিয় মানুষকেই আর দেখতে পাননি। সুনন্দাদেবী বলছেন, ‘‘এখানে ও দেশের অনেকে আছেন, বিয়ে-অনুষ্ঠানে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। ময়মনসিংহ সম্মিলনীতে অনেকে আমায় পরিবার-সূত্রে চিনতে পারেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মানুষদের দেখা
সেখানে পাই না। কাছের মানুষগুলো হারিয়েই গিয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন