নিষ্প্রদীপ আইসিইউ। বৃহস্পতিবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
তীব্র গরমে অন্ধকার ঘরে ছটফট করছেন হৃদ্রোগীরা। কেউ প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে হাঁফাচ্ছেন। সদ্যপ্রসূতি মাথা ঘুরে বিছানায় পড়ে গিয়েছেন।
শিশুদের ওয়ার্ড জুড়ে শুধু একটানা কান্নার আওয়াজ। সামলানো যাচ্ছে না তাদের। কেউ বমি করছে, কেউ গোঙাচ্ছে।
লিফ্ট বন্ধ। ওয়ার্ডে মোমবাতি আর টর্চ নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রামমোহন বিল্ডিংয়ের তিনতলার আইসিইউ-তে দু’টি ভেন্টিলেটরের একটিও চলছে না। সমস্ত মনিটর বন্ধ। কোনওমতে ইমার্জেন্সি ওষুধ দেওয়ার ইনফিউশন পাম্প আর অক্সিজেন চালিয়ে রাখা গিয়েছে। তীব্র গরমে অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের।
তিন ঘণ্টা কেটে গেলেও অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় দিশাহারা রোগীর আত্মীয়-পরিজনেরা কখনও বাইরে ছুটে গিয়ে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। পরক্ষণেই আবার ওয়ার্ডের ভিতরে গিয়ে মোবাইল ফোনের
আলো জ্বেলে রোগীকে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছেন।
হাসপাতালে দু’টি জেনারেটর। এই রকম সঙ্কটের মুহূর্তে সাকুল্যে পনেরো মিনিটের বেশি কোনওটিই চালানো যায়নি। বিকল হয়ে গিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই ছিল রাজ্যের অন্যতম নামী ওই মেডিক্যাল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিক্যালের পরিস্থিতি। বিকেল সওয়া পাঁচটা নাগাদ গোটা হাসপাতাল অন্ধকারে ডুবে যায়। উদ্বেগ-আতঙ্কে ছুটোছুটি করতে থাকেন রোগীর আত্মীয়েরা। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা কাজে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যে সার্জারি ও চেস্ট বিল্ডিংয়ের লাইন ঠিক করেন। কিন্তু গাইনোকোলজি বিল্ডিং ও রামমোহন বিল্ডিংয়ের লাইন কিছুতেই সারানো যাচ্ছিল না। দু’টি জেনারেটরও কিছুক্ষণ চলার পরে আর ‘লোড’ টানতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়।
এমনিতেই এ দিন দুপুর থেকে কলকাতায় তীব্র গরম ছিল। অস্বস্তিসূচক ছিল অনেক উপরে। তার মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে প্রাণান্তকর অবস্থা হয় রোগীদের। বিশেষ করে রামমোহন বিল্ডিংয়ে শিশুদের ও হৃদ্রোগীদের ওয়ার্ডে। রোগীদের ছটফট করতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁদের বাড়ির লোকজন। কেন একটা মেডিক্যাল কলেজে সাড়ে তিন ঘণ্টার উপরে বিদ্যুৎ থাকবে না, তোলেন সেই প্রশ্নও। এক সময়ে ক্ষুব্ধ আত্মীয়েরা রামমোহন বিল্ডিংয়ের একতলায় একাধিক ঘরে ভাঙচুরও চালান। পুলিশ এলে তাদের সামনেও বিক্ষোভ দেখানো হয়।
রাত ৮টা নাগাদও আলো না আসায় হাসপাতালের সামনে হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় অধ্যক্ষা মঞ্জুশ্রী রায়কে। মঞ্জুদেবী বলেন, ‘‘পূর্ত দফতরের লোকজন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন লাইন ঠিক করার। দুটো জেনারেটরও বাইরে থেকে আনা হচ্ছে।’’ কিন্তু হাসপাতালের জেনারেটর কেন চলল না? অধ্যক্ষার উত্তর, ‘‘হাসপাতালে এতক্ষণ আলো না থাকার কথা তো বুঝতে পারা যায়নি। দু’-পাঁচ মিনিট হলে জেনারেটর টানতে পারে। কিন্তু এতক্ষণ টানতে পারে নি।’’ আরও বলেন, ‘‘ওই সময়ে যত জরুরি অস্ত্রোপচারের কেস এসেছে, সেগুলি সব সার্জারি বিল্ডিংয়ে করতে বলা হয়েছে। তাতে কোনও সমস্যা হয়নি।’’
সে সময়ে কয়েক জন রোগীর আত্মীয় এসে অভিযোগ জানাতে থাকেন, হাসপাতালের কিছু লোক তাঁদের ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যেতে বলছেন। তা হলে গরমে ছটফট করা রোগীদের বাতাস করবে কে? জল দেবে কে? এরই মধ্যে গুরুতর অসুস্থ এক রোগীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে করে হাসপাতালে ঢোকেন কয়েক জন। হাসপাতালের অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে তাঁরা ট্যাক্সি ঘুরিয়ে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের দিকে রওনা হন। শেষ পর্যন্ত রাত ন’টা নাগাদ বিদ্যুৎ আসার পরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়।