প্রতীকী ছবি।
করোনা-সংক্রমণের ডামাডোলের মধ্যে যাঁরা আচমকা অন্য রোগে অসুস্থ বা দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছেন কিংবা সংক্রামক রোগে ভুগছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ভোগান্তি চরমে বলে অভিযোগ। যার জেরে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন নাজেহাল হতে হচ্ছে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের। তবে এমন রোগীদের যাতে ভোগান্তি না হয়, তা নিয়ে সম্প্রতি নির্দেশিকা জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা, বছর পঞ্চাশের জরিশিল্পী শেখ নিসারুদ্দিন কিছু দিন ধরেই কিডনির চিকিৎসায় এসএসকেএমের ইউরোলজি বিভাগে দেখাচ্ছেন। সম্প্রতি কাশি-শ্বাসকষ্ট নিয়ে উলুবেড়িয়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখান থেকে এসএসকেএমে রেফার করা হয়। নিসারুদ্দিনের দাবি, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে পিজিতে গেলাম। তখন শ্বাস নেওয়ারও ক্ষমতা নেই। ইমার্জেন্সি থেকে বলল, রোগী নেওয়া হবে না। বাড়ির লোকের অনুরোধে ইকো করাতে বলা হয়। সেখানে গেলে পাঠানো হয় কিডনির বিভাগে। সেখানে ডাক্তারেরা পরের সোমবার আউটডোরে যেতে বলেন। শেষে পার্ক সার্কাসের এক নার্সিংহোমে পরীক্ষা করে দেখা যায়, স্ট্রোক হয়েছে। পিজি সেটুকুও দেখল না!’’
ফুলবাগানের আসিয়া খাতুন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তাঁর স্বামী মহম্মদ সাজিদ খানের অভিযোগ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চেক-আপ
করাতেন আসিয়া। ২ এপ্রিল শরীর খুব খারাপ হওয়ায় আসিয়াকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানান, সেখানে শুধু করোনা রোগীদেরই ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। আসিয়াকে ন্যাশনাল মেডিক্যালে ভর্তি করলে মৃত সন্তান প্রসব করেন। পরদিন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ৪ তারিখ থেকে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাজিদের অভিযোগ, ‘‘ন্যাশনালের ইমার্জেন্সিতে বারবার ভর্তির অনুরোধ করলেও ফিরিয়ে দেয়। এর পরে কাছের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করাই। সেখানে পরীক্ষা করে জানায়, সেপসিস হয়ে গিয়েছে। জানি না, খরচ কী করে দেব।’’
বেনিয়াপুকুরের বাসিন্দা মনসুর আলম জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। করোনা হয়েছে কি না জানতে তাঁর লালারস পরীক্ষা করলে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। হাসপাতাল তাঁকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মনসুরের জ্বর ও শ্বাসকষ্ট কমেনি। অথচ, শহরের কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল তাঁকে ভর্তি নিচ্ছে না বলে অভিযোগ।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলি থেকে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা হাসপাতালগুলিতে পাঠানো হচ্ছে। বহু ভেন্টিলেটর করোনা রোগীদের জন্য রাখতে হচ্ছে। রক্তেরও সঙ্কট। ফলে একেবারে জরুরি ছাড়া কোনও পরিষেবা হাসপাতালের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। গুরুতর অসুস্থেরা যাতে না ফিরে যান, সেটা দেখা হচ্ছে।’’ লকডাউনের জেরে কলকাতা ও জেলা জুড়ে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি নার্সিংহোম ক্ষতির আশঙ্কায় ঝাঁপ ফেলেছে। ফলে সরকারি জায়গায় চিকিৎসা না পেয়ে সেখানে যাওয়ার পথও বন্ধ। অনেকের মাঝপথে কেমোথেরাপি, ডায়ালিসিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি জায়গায় আটকে রয়েছে কিডনি প্রতিস্থাপন, অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি বা ওপেন হার্ট সার্জারি।
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোগ্রেসিভ নার্সিংহোম অ্যান্ড হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য চেয়ারম্যান শেখ আলহাজউদ্দিনের কথায়, ‘‘ক্ষতির আশঙ্কায় রাজ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪৫টি নার্সিংহোম বন্ধ। সব চেয়ে বেশি বন্ধ হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর ও বর্ধমানে।’’ জেলায় বহু দোকানে ওষুধ মিলছে না। সাধারণ ইনসুলিন বা অ্যান্টিবায়োটিক পেতে কালঘাম ছুটছে। গ্রামীণ চিকিৎসকদের অনেকেই সংক্রমণের ভয়ে চেম্বার খুলছেন না। অর্থাৎ, গ্রাম থেকে যাঁরা শহরে চিকিৎসার জন্য আসতে পারছেন না, তাঁরা যে ন্যূনতম পরিষেবা পাবেন, সেই উপায়ও নেই।