আদিগঙ্গার পাড় থেকে খাটাল সরাতে বলেছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। সেই নির্দেশ কার্যকর করার জন্য মার্চের মাঝামাঝি পুলিশি সাহায্য চেয়ে লালবাজারে বৈঠকেও বসেছিলেন কলকাতা পুরসভা এবং প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতরের কর্তারা। কিন্তু খাটাল সরানো হবে কোথায়?
পুরসভা সূত্রের খবর, খাটাল সরানোর জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি। চলতি মাসের গোড়ায় জাতীয় পরিবেশ আদালতে জমা দেওয়া হলফনামায় বলা হয়েছে, ভোটের নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় জায়গা সন্ধানে আরও দেরি হতে পারে। ফলে ভোট মেটার আগে আদিগঙ্গার দূষণে যে লাগাম টানা যাবে না, সে কথাও ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিয়েছেন পুরকর্তারা।
পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, খাটাল, খাটা পায়খানা এবং দূষিত নিকাশি-বর্জ্য থেকে আদিগঙ্গা দূষণের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। যার প্রকোপ পড়ছে কলকাতা বন্দর, ভবানীপুর এবং টালিগঞ্জ এলাকার বহু বাসিন্দার উপরে। বিশেষত, আদিগঙ্গার গা ঘেঁষে যাঁদের বাড়ি, তাঁদের ক্ষেত্রে এই দূষণের কবলে পড়ার আশঙ্কা আরও বেশি।
পরিবেশবিদদের বক্তব্য, জলে মলমূত্র এবং জঞ্জাল মেশার ফলে নানা ক্ষতিকারক ও রোগসৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে। যে বৃদ্ধির হার বোঝা যায় ওই জলে ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাক্টেরিয়ার মাত্রা দেখে। আদিগঙ্গার ক্ষেত্রে সেই মাত্রা মাপতে গিয়ে চোখ কার্যত ব্রহ্মতালুতে গিয়ে ঠেকার জোগাড় হয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসারদের।
পর্ষদের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে ভাটা চলার সময়ে বাঁশদ্রোণী ও কালীঘাট এলাকায় ফিক্যাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৯০ লক্ষ! ‘‘প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ফিক্যাল কলিফর্মের স্বাভাবিক সর্বোচ্চ মাত্রা ৫০০। তা হলেই ভাবুন আদিগঙ্গার দূষণ কতটা ভয়ঙ্কর!’’— মন্তব্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক কর্তার। আদিগঙ্গা নিয়ে কলকাতার জাতীয় পরিবেশ আদালতে রিপোর্ট দিয়েছে পর্ষদও।
আদিগঙ্গার দূষণের মামলায় আদালত-বান্ধব হিসেবে নিযুক্ত পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, গত ৩ মার্চ শুনানিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, দূষিত নিকাশি বন্ধ করতে হবে। তুলে ফেলতে হবে কঠিন বর্জ্য। ভাঙতে হবে আদিগঙ্গার পাড় দিয়ে থাকা খাটা পায়খানা। ‘‘ওই সব কাজের জন্য এক মাস সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল,’’ বলছেন সুভাষবাবু।
সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে কী করেছে পুরসভা?
পুরসভা সূত্রের খবর, খাটাল তো সরানো হয়ইনি, উল্টে ঠিকাদার বাছাই করতে গিয়েও পুরসভা দেরি করেছে। ফলত কঠিন বর্জ্য তোলার কাজ শুরু হতেও দেরি হয়েছে। তবে হলফনামায় পুরসভার দাবি, এই কাজ এখন অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চলছে। ১২টি খাটা পায়খানা ভেঙে ৫টি পাকা শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে। তবে আরও বহু খাটা পায়খানা ভাঙা বাকি।
দূষিত নিকাশির ক্ষেত্রেও কাজ যে খুব এগিয়েছে, এমন দাবি করছেন না পুরকর্তাদেরই একাংশ। তাঁরা বলছেন, নিকাশি নালার ক্ষেত্রে ৫৭টি ‘পেনস্টক গেট’ ছিল। সেগুলি দিয়ে আদিগঙ্গায় নিকাশি এসে পড়ত। তার মধ্যে ২১টি বন্ধ করা গিয়েছে, বাকি আছে ৩৬টি। পুরসভা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একাংশ বলছেন, বর্ষাকালে নিকাশি ও বৃষ্টির জল মিশে আদিগঙ্গায় পড়ায় দূষিত পদার্থ কিছুটা দ্রবীভূত হত। কিন্তু এ বছর মার্চ-এপ্রিলে বৃষ্টি না হওয়ায় সেই দূষণ আরও বাড়ছে।
যদিও পুরসভার ‘গেট বন্ধ’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক শীর্ষকর্তা। তিনি বলছেন, নালার মুখ বন্ধ করে কখনও পাকাপাকি ভাবে দূষণ রোধ করা যাবে না। উল্টে বর্ষায় নিকাশির জল উল্টো দিকে বয়ে (ব্যাক ফ্লো) এলাকার আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
তা হলে কি দূষণ রুখতে গিয়ে এ বার বর্ষায় ডুবতে পারে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ এলাকা?