অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায়। (১) সীমান্ত বেরা (২) মনোতোষ পাল (৩) সন্দীপ সেন (৪) ঝগরু শাহ। — নিজস্ব চিত্র
এত দিন পর্যন্ত ছোট-বড় যে কোনও সরঞ্জামের প্রয়োজনে ওঁদের হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হত। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিতেন, সরঞ্জাম কিনে আনতে পারলে অস্ত্রোপচার হবে। নচেৎ অনন্ত প্রতীক্ষা। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমন কী দারিদ্রসীমার নীচের রোগীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ছিল একই। মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত চিকিৎসা ফ্রি ঘোষণা করার পরে এঁদের অবস্থা হয়েছে আরও শোচনীয়। কারণ হাসপাতালে সরঞ্জামের জোগান নেই। আর প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেও শাস্তির কোপ। ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অস্ত্রোপচার। প্রায় সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগেই এই ভোগান্তির ছবি।
সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতালই হোক অথবা আরজিকর বা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ— অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসকেরা মুখের উপর জানিয়ে দিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ নেই, তাই অস্ত্রোপচার হবে না। কবে তা করা যাবে তা-ও বলা যাচ্ছে না, কারণ স্বাস্থ্য দফতর কেনার ব্যবস্থা করছে না। এই হাসপাতালগুলিতে এখনও স্পট কোটেশন করে, দরপত্র ডেকে নন-ক্যাটালগ (সরকারি তালিকায় যা নেই) জিনিস কেনা হয়নি। ফলে অর্থোপেডিক ইমপ্ল্যান্ট বসানো কার্যত বন্ধ। ওয়ার্ডে বন্দি হয়ে যাওয়া মানুষগুলি আবার কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, কবে সংসার চালানোর জন্য কাজ শুরু করতে পারবেন, কেউ বলতে পারছে না।
এসএসকেএমে ভর্তি কান্ত হালদার, সীমান্ত বেরা, সন্দীপ সেন, বাবু শেখ, ঝগরু শাহ, মনোতোষ পাল-এর মতো বহু রোগীর একই অবস্থা। সন্দীপবাবুর বাড়ি টলিগঞ্জে। ১০০ দিনের কাজে ব্যানার লাগাতেন। সেই ব্যানার খুলতে গিয়েই পড়ে গিয়ে বাঁ পা ভেঙেছে। তিন মাস এসএসকেএমে ভর্তি, কিন্তু অস্ত্রোপচার হয়নি এখনও। তিনি বলেন, ‘‘ডাক্তারদের বলতে বলতে হাঁফিয়ে যাচ্ছি। সংসারটা ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা বলছেন, জিনিসপত্র কেনা যাচ্ছে না বলে অপারেশন করবেন না।’’
পাশের শয্যাতেই ভর্তি সুন্দরবনের বাসিন্দা সীমান্ত বেরা। মাসখানেক আগে হাত দিয়ে চালানো বিশেষ গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ পা টুকরো হয়ে যায়। এক মাস ধরে এসএসকেএমে ভর্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁর অস্ত্রোপচার হয়নি। সারা দিন যন্ত্রণায় গোঙান ওই যুবক। বললেন, ‘‘আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু করুন। এরা তো কিছুতেই অপারেশন করছে না। শুধু বলছে, যন্ত্রপাতি না এলে হবে না।’’ খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জে ঠেলা করে কলা বিক্রি করতেন বৃদ্ধ ঝগরু শাহ। একটি গাড়ির ধাক্কায় দুই পা-ই টুকরো হয়ে গিয়েছে। লোহার স্ক্রু ঢুকিয়ে ট্র্যাকশন দিয়ে রাখা। প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার এক মাস ধরে আর হচ্ছে না। কাতরাতে কাতরাতে বললেন, ‘‘হাঁটু থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত বিদ্যুতের শক লাগার মতো যন্ত্রণা হয়। ডাক্তারবাবুদের পায়ে ধরে বলেছি, আমার ছেলে জিনিস কিনে আনবে লিখে দিন। ওঁরা সেটাও দেবে না। আমি এ বার মরে যাব।’’ এসএসকেএমের অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্থোপেডিক্সের বিভাগীর প্রধানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা কেউ উত্তর দিতে চাননি।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত দু’সপ্তাহ অর্থোপে়ডিক ইমপ্ল্যান্ট বসানোর সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। সুপার পীতবরণ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘নন-ক্যাটলগ ইমপ্ল্যান্টগুলি কেনার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। স্পট কোটেশনের টেকনিক্যাল বিড হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিক বিডটা বাকি। তবে সমস্যাটা বেড়েছে আমাদের সি-আর্ম যন্ত্রটা খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য। জটিল অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না।’’ যদিও ন্যাশনাল সূত্রের খবর, সি-আর্ম যন্ত্রটা প্রধান কারণ নয়। নন-ক্যাটলগ অর্থোপে়ডিক ইমপ্ল্যান্ট কেনার দরপত্র চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না কারণ বিভাগীয় প্রধান অলয়জ্যোতি কুণ্ডুকে বার বার বলা সত্ত্বেও তিনি দরপত্র বাছাইয়ে উপস্থিত থাকছেন না। তাঁর কাছ থেকে এ ব্যাপারে উত্তর মিলেছে, ‘‘আপনাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা করব না। সুপারের থেকে জেনে নিন।’’
একই পরিস্থিতি কলকাতা মেডিক্যাল ও এনআরএসে। মেডিক্যালে ভর্তি এক রোগীর আত্মীয় সোনু যাদব বলেন, ‘‘বাইরের নার্সিংহোমে ভর্তি করে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। ডাক্তারবাবুদের বার বার বলছি, কী লাগবে বলুন, আমরা জোগাড় করতে পারব। ওঁরা সেটাও বলছেন না। এ বার আমার বাবার ভাঙা হাতটাই আর জো়ড়া লাগবে না।’’ কবে এই সব সরঞ্জামের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে? মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তপন লাহিড়ি জানান, নিশ্চিত করে কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
এনআরএসের অবস্থাও তথৈবচ। একটি অস্ত্রোপচার হলে পরবর্তী পাঁচটি হচ্ছে না। ডাক্তারদের একটা বড় অংশই বলছেন, ‘‘আমাদের হাত-পা বাঁধা। কিছু সরঞ্জাম লোকাল পারচেজ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সব কিছু তো সে ভাবে করা সম্ভব নয়। তাই অধিকাংশ রোগীকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। ইন্ডোরে ভর্তি রোগীরা কেউ ছুটি পাচ্ছেন না।’’ এনআরএস কর্তৃপক্ষ জানান, স্বাস্থ্য ভবন থেকে সামগ্রিক কোনও ব্যবস্থা চালু না হলে রোগীদের ভোগান্তি ঠেকানো সম্ভব নয়।
কবে সেই ব্যবস্থা চালু করবে স্বাস্থ্য ভবন? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সব বন্দোবস্ত পাকা। দিন কয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’
সেই ‘দিন কয়েক’ কবে আসবে, সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।